ইনি এবার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। একাত্তর এর পর থেকে উনার সাফল্যের যাত্রা শুরু। একাত্তরে ছিলেন অল বদর বাহিনীর কমান্ডার। তারপর যখন যে দলে সুযোগ পেয়েছেন সেই দলেই যোগ দিয়েছেন। দু বার হজ পালন করেছেন। প্রতি বছরই ওমরা পালন করার উদ্দেশ্যে আরব দেশে যান। রয়েছে উনার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। গত কয়েক নির্বাচনে তিনিই জয়ী হয়েছেন। কারণ এই গ্রামে উনার প্রতিদ্বন্দীতা করবে এমন সাহস কারও নেই।
এই বার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। লোকজন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়ে গেছে। এখন আর ভয় দেখিযে সব কাজ আদায় করা যায না। তাই এবার ঠিক করেছেন পাবলিক সেন্টিমেন্টস কে কাজে লাগাবেন। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস হওয়াতে সুযোগ পেয়ে গেছেন। ঠিক করেছেন এবার ১৬ ডিসেম্বরে হাই স্কুল মাঠ প্রাঙ্গনে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ১০০ টাকা আর নিজ হাতে স্বাক্ষর করা সনদ প্রদান করবেন।
মুশকিল হল গায়ের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কেউ বর্তমানে বেচে নেই। ঐ একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার কে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আর বাদবাকী চেয়ারম্যান সাহেবের পছন্দের লোকজনের নাম দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার লিস্ট বানানো হয়েছে।
নির্ধারিত দিনে চেয়ারম্যানের দেশপ্রেমের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। চেয়ারম্যান সাহেব নিজ হাতে প্রত্যেককে ১০০ টাকা আর সনদ প্রদান করছেন। চারদিক থেকে হাততালির মাধ্যেম মাঠ প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে রয়েছে। সনদপ্রাপ্ত সবাই চেয়েরম্যান সাহেবের সাফল্য কামনা করে তাদের বক্তব্য শেষ করছেন।
সব শেষে তিনি শেষ মুক্তিযোদ্ধার হাতে সনদ তুলে দিতে গেলেন। এই লোক সনদ গ্রহন না করেই আমার কিছু কথা আছে’- বলে এগিয়ে গেল স্টেজের মাইক্রোফোনের দিকে।
-আমাদের মুক্তিযোদ্ধ অনেক বড় একটি ব্যাপার। এর আগে পর্যন্ত আমরা মৃত মানুষের মত বেচে ছিলাম। এ সময়েই আমরা শিখলাম সত্যিকারের আত্নত্যাগ কি জিনিস। আমার শিখলাম ঘৃনা করতে, ভালোবাসতে, জীবন দিতে।
১৯৭১ এ আমি যুদ্ধ করেছি। কখনও যুদ্ধ করব আমি ভাবিনি। কিভাবে যুদ্ধ করতে হয় আমার জানা ছিল না।
ঐ সময় আমার দেশের লোকজন খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। তখন আমার ভিতর থেকে তাড়া আসল যাও তাদের পাশে গিয়ে দাড়াও। আমি শুধু তাই করলাম।
নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধা যারা আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাদের পরিবার বেচে রয়েছে। যারা বেচে রয়েছেন তাদের খবর রাখার প্রয়োজনও আমরা বোধ করি না। তাদের আত্নত্যাগের কাছে আমার এই আত্নত্যাগতো কিছুই না।
আমি একজন হতদরিদ্র স্কুল মাস্টার। আমি সবাইকে লেখাপড়া শিখাই আর অর্থের অভাবে আমি আমার ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারছি না। এটা নিয়ে হয়ত আমার কষ্ট রয়েছে। তারপরও সেই কষ্ট চেষ্টা করে ভুলে থাকা যায়। ভাল খেতে পারব, ভাল পড়তে পারব এর জন্যেতো আমরা যুদ্ধ করিনি। নিজের স্বার্থের জন্যেতো দেশের মানুষ জীবন দেয়নি। হয়ত যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখে ছিলাম সেই দেশ পাইনি। কিন্তু এর জন্যেতো দেশের প্রতি অজস্র মানুষের ভালোবাসা বিফলে যেতে পারে না। হয়ত সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনও আমরা পাইনি, তাই বলে স্বাধীনতার জন্যে মানুষের আত্নত্যাগতো অর্থহীন হতে পারে না।
সব কিছু ভুলে থাকা যায়। কিন্তু যখন এত বছরেও দেশের যুদ্দ অপরাধিদের বিচার হয়না। একজন রাজাকার দেশের পতাকা লাগানো গাড়ীতে ঘুরে বেড়ায়। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তার সন্মান ভিক্ষা হিসেবে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিতরণ করে একজন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তখন খুব কষ্ট হয়। সেই কষ্ট আমরা ভুলে থাকতে পারি না। তখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে খুব লজ্জা হয়।
মাস্টারের হয়ত আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নেয়া হয়। ক্যাডার বাহিনী টেনে হিচড়ে উনাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়। সবাই বলাবলি করতে থাকে- আহারে অনাহারে থেকে থেকে এবার বোধ হয় আসলেই মাস্টারের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।
পরদিন থেকে গ্রামে তিনি পাগলা মাস্টার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
Wednesday, December 17, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment