Thursday, June 5, 2008

পরাধীনতা

মরুভূমির তপ্ত বালিতে এক ইরাকি মহিলা শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন ঠিক না, শুতে বাধ্য হয়েছেন। মর্টারের গোলার আঘাতে তিনি মারাত্নক ভাবে আহত হয়েছেন। অনবরত রক্তরণ হচ্ছে। রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মরুভূমির বালি তা শুষে নিচ্ছে। তিনি জানেন মৃত্যু আসছে খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে। নিজের জন্যে তার খারাপ লাগছে না, তার পরিবারের সবাই বোমার আঘাতে মারা গেছে, একা তিনি কার জন্যে বেঁচে থাকবেন। খারাপ লাগছে তার অনাগত শিশুর জন্যে, যে আর কয়েকদিন পরই এই পৃথিবীতে আসত।
মা, মা ডাকে তিনি চমকে উঠেন, কে ডাকছে?
মা আমি, তার ভ্র“ণ তার সঙ্গে কথা বলছে!
একি তার অবচেতন মনের কল্পনা, নাকি বাস্তবেই এটা ঘটছে? তিনি তার সন্তানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন।
মা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ?
হ্যাঁ, ছোট্র সোনা, আমি শুনতে পারছি।
মা, তুমি কি মারা যাচ্ছ?
আমি জানি না সোনা।
তুমি মারা গেলে কি আমিও মারা যাব মা ? এই পৃথিবী দেখতে পারব না।
ছোট্র সোনা আমার, তুমি এই ভয়ানক পৃথিবীতে এসে কি করবে? চারদিকে এত যুদ্ধ!
যুদ্ধ কেন হচ্ছে মা ?
এক মুহুর্তের জন্যে তিনি থমকে যান। আসলে কেন হচ্ছে এই যুদ্ধ? কিসের জন্যে? এক ফোঁটা তেলের জন্যে কয় ফোঁটা রক্ত ঝরছে, কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে!
সারা শরীর তার অবসাদে ভেঙে আসছে।
ছোট্র মানিক আমার, তুমি শান্তিতে ঘুমাও, আমি ঘুম পাড়ানি গান গাই। কিন্ত কোন ঘুম পাড়ানি গানই তার মনে আসছে না।
এ মুহুর্তে বুশ নিশ্চয় তার ফার্ম হাইজে অবকাশ যাপন করছেন। মার্কিন-ব্রিটিশ শিশুরা হয়ত কম্পিউটারে যুদ্ধের গেইম খেলতে ব্যস্ত। অথচ তাদের মতো সাধারণ লোকের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে কঠিন বাস্তবতা। এক সময় হয়ত এ যুদ্ধ থেমে যাবে, কিন্তু তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ কি কখনও শেষ হবে ? সে যুদ্ধ ক্ষুধার যুদ্ধ, দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ!
মা, মা আমি তোমাকে দেখতে চাই মা !
তার বাচ্চা এ পৃথিবীতে আসার জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি ফিসফিস করে বাচ্চাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনানোর চেষ্টা করছেন। তার বাচ্চার এ ঘুম আর কখনও ভাঙবে না।
মরূভূমিতে দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসে। এক সময় রাতের আঁধার কেটে গিয়ে দিনের আলো ফুটবে, কিন্তু সেই আলো তিনি দেখতে পাবেন না। তার বাচ্চা দেখতে পাবে না। কিছু রাত আছে যার কোন ভোর নেই।

(বেশ কিছুদিন আগে ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ চলাকালীন সময় পত্রিকায় আমি এক ইরাকী আত্নঘাতী হামলাকারীর খবর পড়ি, সেই হামলাকারী ছিলেন একজন মহিলা এবং তিনি ছিলন গর্ভবতী। ব্যপারটা বুঝতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। যুদ্ধ একটা মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়!
বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা একটা অস্থির সময় কাটাচ্ছি, তারপর ইশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার জন্ম ইরাকের মত কোন পরাধীন রাষ্ট্রে না হয়ে একটি স্বাধীন দেশে হয়েছে।
সপ্ম্প্রতি আমেরিকায় পোষা প্রাণীদের বিনোদনের জন্যে কিছু ক্লাব খোলা হচ্ছে। উত্তম প্রস্তাব। আমি খুব আশাবাদী, কারণটা ব্যাখা করছি-
ছোট বেলায় কবি জীবনান্দ দাশের একটি কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম-
আমি আবার আসিব ফিরে, এই ধাঁনসিড়িটির তীরে
হয়ত শালিক, নয়ত কোন শঙ্খচিলের বেশে।
পরজন্মে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব আমাকে যদি আবার পৃথিবীতে পাঠানো হয় তবে যেন আমার জন্ম ইরাকের মাটিতে না হয়। আমেরিকার মাটিতে, অন্তত মানুষ না হলেও কুত্তা (কুকুর সমাজ মা করবেন) হিসেবে।
আমি আবার আসিব ফিরে, এই পৃথিবীতে
হয়ত মানুষ, নয়ত কোন আমেরিকান কুত্তার বেশে।

No comments: