Thursday, June 5, 2008

হিউম্যান বম্ব

অবর্ণনীয় কষ্টে মামুনের সমস্ত শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে।
অবশ্য শরীর বলতে এখন আর তেমন বেশী কিছূ অবশিষ্ট নেই, বোমার অঘাতে কোমরের নীচের অংশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে।
মামুন তার আবছা আবছা চেতনায় বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে, স্বর্গে তো কোন কষ্ট থাকার কথা নয়। তার মানে এখন সে রয়েছে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি।
ডাক্তার নার্সরা মিলে প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে মামুনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে। মামুনের খুব ঘুম পাচ্ছে, সে যদি একবার ঘুমিয়ে পড়তে পারে তাহলে সেই ঘুম আর ভাঙবে না। কিন্তু এরা তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না।
বাবা তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? -দূর থেকে মার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। মামুন বুঝতে পারছে না মা এখানে কিভাবে এল। সে তো বাড়ীতে কাউকে বলে আসেনি।
উনিশ বছরের এক উচ্ছল যুবক মামুন। অভাবের সংসারে হাইস্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি। বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করে সময় কাটত। হঠাৎ করে গ্রামে কিছু রহস্যময় লোকের আগমন ঘটে। আরও রহস্যময় তাদের কথাবার্তা আচরণ। মামুনের এতদিনের চেনা জগৎটা হঠাৎ করে বদলে যেতে শুরু করে । চোখের সামনে এক অচেনা জগতের হাতছানি। মামুনের তরুণ রক্তে বইছে নতুন কিছু করার ইচ্ছা, সে সহজেই এই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রথম প্রথম চলে ধর্মীয় পুস্তকের আলোচনা, ভিডিও প্রশিক্ষন- জিহাদী সব বক্তৃতায় রক্ত গরম হয়ে উঠত। সবশেষে বোমায় হাতেখড়ি ।
তারপর আসে সেই দিন যেদিন মামুন নিজেই একটি হিউম্যান বম্বে পরিণত হয়।
দল নেতা একদিন মামুনের কাঁধে হাত রাখেন-আগামীকাল তুমি এক নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছ। মিশন সাফল্যের সাথে শেষ করতে পারলে তোমার এই আতœত্যাগ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তুমি পাবে শহীদের মর্যাদা, বেহেসস্তর দরজা তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
পরাদিন কাউকে কিছু না বলে মামুন বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। মামুন ছেলে বেলায় ৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের কথা শুনে ছিল। ঐ সময় ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে ছিল, কিন্তু তা ছিল দেশের শত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধ কাদের বিরুদ্ধে মামুনের ক্ষুদ্র মস্তিস্ক ধরতে পারে না।
মামুনের শরীরে বাঁধা বোমার আঘাতে কত লোক মারা গেছে মামুন তা জানে না। তাদের কি আপরাধে মরতে হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন নিরীহ লোক, কতজন বাচ্চা রয়েছে মামুন তাও জানে না।
খোকা ও খোকা-মা আকুল হয়ে ডাকছে।
হঠাৎ করে ডাক্তারের মুখটা বাবার ভাঙাচোরা চেহারা বলে মনে হয়। মামুন বুঝতে পারছে এসব তার অবচেতন মনের কল্পনা, বাস্তবে আসলে এসব ঘটছে না। কিন্তু বাস্তবে হলে খুব ভাল হত। পরিবারের লোকজন তাকে ঘিরে থাকত আর সে তার মায়ের কোলে মাথা রেথে নিশ্চিন্ত মরতে পারত। সে তো একজন শহীদের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে, তারপরও কেন তার বুক চিরে কান্না উথলে উঠছে। একদিকে স্বর্গের অনন্ত সুখ, অপর দিকে কষ্টের এই পৃথিবী।
মামুন বিড়বিড় করে বলতে থাকে-মা, আমি ক্ষমার অযোগ্য আপরাধ করেছি, মৃত্যুপথযাত্রী তোমার এই ছেলেকে ক্ষমা কর মা। পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে আমি আবার তোমার ছেলে হয়ে জন্ম নিতে চাই, একবার না বারবার।
মামুনের মন চলে যায় তার শৈশবে। রাতের বেলা মায়ের কাছে রুপকথা শুনা, বাবার হাত ধরে গ্রামের পথে হেঁটে চলা, ছোট বোনের সাথে দূষ্টুমির সেই ক্ষণ।
ঈশ্বর- মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা নাকি পূরণ হয়। আমার মৃত্যু আসন্ন, মৃত্যুর পর আমার স্থান কোথায় হবে, আমি জানি না। আমি যে ভুল করেছি তার কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই, তারপরও যাদি বেঁচে থাকি তবে শুধু একটি মুহূর্তের জন্যে ফিরিয়ে দিও আমার সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশব, শুধু মাত্র একটি মুহূর্তের জন্যে-ধীরে ধীরে মামুনের কন্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। হাসপাতালের বেডের পাশে রাখা মনিটরে মামুনের লাইফ লাইন ও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে।



(বিভিন্ন আত্নঘাতী বোমা হামলাকারীদের ধরা পড়ার খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পাচ্ছি। কিন্ত এদেরকে শুধু ঐ কাজের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আসল আপরাধীরা এখনও রয়ে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরে।

এর পেছনে যারা রয়েছে তারা কি এক সময় শাস্তি পাবে, আত্নঘাতী বোমা হামলা কি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হবে, আমরা জানি না।

হয়ত আবার কিছুদিন পর অশূভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু জঙ্গীবাদের শিকার মামুন নামের সেইসব আত্নযাতী হামলাকারীরা আর সেই হামলার শিকার সেইসব নিরীহ লোকজন আর কখনও ফিরে আসবে না। )

No comments: