ভাষা শহীদ রফিকের আবেদন ঈশ্বর শেষ পর্য়ন্ত মঞ্জুর করেন। এক দিনের জন্যে তিনি বাংলাদেশ দেখে যাবেন। যে ভাষার জন্যে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সে ভাষার এতদিনে কতটুকু উন্নতি ঘটেছে তা দেখাই উনার উদ্দেশ্য।
প্রথমেই তিনি চলে আসেন বাংলা একাডেমিতে। এখন সেখানে বই মেলা চলছে। মেলার গেইটে পাঠকের দীর্ঘ লাইন। প্রশান্তিতে শহীদ রফিকের বুক ভরে যায়।
মেলায় প্রবেশ করেই তিনি ভ্যবাচেকা খেয়ে যান। সম্ভবত ভুল করে তিনি কোন কমিউনিটি সেন্টারে চলে এসেছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। চারদিকে হলুদ পাঞ্জাবি পড়া ছেলে আর হলুদ শাড়ী পড়া মেয়েদের ছড়াছড়ি। সম্ভবত এরা বর পরে লোকজন। কিন্তু সবাই একই রঙের এতগুলি পোষাক কোথা থেকে যোগাড় করেছে। স্টেজে বর কনে সেজে বসে আছে, পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
এটা কি ধরণের বিয়ে রে বাবা- শহীদ রফিক বুঝতে পারেন না। একটু খোঁজ করতে গিয়ে উনার ভুল ভাঙে। এখানে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। দেশের একজন প্রখ্যাত লেখকের বই এর পাবলিসিটি চলছে।
গভীর বেদনা নিয়ে শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। সবাই লাইন দিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বই কিনছে। বাচ্চারা কিনছে ভূত-পেত্নীর বই। এক সময় এই বাচ্চারা বড় হবে ভূত-পেত্নীদের সাথে নিয়ে। যে ভাষায় তারা কথা বলছে সেই ভাষার পেছনে যে আমাদের এক গৌরবময় ইতিহাস জড়িত এটা তাদের জানানোর চেষ্টা কেউ করছে না। তাদের জন্যে এ ধরনের তেমন কোন বইও নেই। শহীদ রফিক মন খারাপ করে মেলা থেকে বেরিয়ে যান।
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন শহীদ মিনার চত্বরে। যেখানে এক সময় এই ভাষার জন্যে উনার মতো আরও অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। চারদিকে নোংরা কাগজপত্র পড়ে আছে। ঝাড়ু– দেয়ার কেউ নেই। খালি কয়েকজন ফেরিওয়ালা ঘোরা ফেরা করছে। শুধু মাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২ টার পর থেকে এখানে লোকজনের ঢল নামে। খালি পায়ে কার আগে কে গিয়ে শহীদ মিনার চত্বরে ফুল দিবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
এবার তিনি চলে আসেন দেশের এক নামকরা প্রইভেট ইউনির্ভাসিটিতে। এখানকার ছেলে মেয়েরা বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে এক অদ্ভূত ভাষায় কথা বলছে। এ নতুন ভাষা তারা কোথা থেকে আমদানি করেছে তিনি বুঝতে পারছেন না। সময়ের সাথে দেশের পরিবর্তন ঘটতে শুনেছেন, তার সাথে কি ভাষারও এত পরিবর্তন ঘটে তিনি জানেন না। এখানকার ছেলে মেয়েদের কাছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে চাওয়া রীতিমতো দুঃসাহসের ব্যপার। কারণ এরা ডিজুস নামক এক নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়ে। তিনি এই প্রজন্মের সাথে পরিচিত নন।
শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। এবার তিনি চলে যান পাবলিক লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে প্রচুর বই, কিন্তু পড়ার লোক নেই। কিছু পাঠক আছে । এর মধ্যে কয়েকজন পড়ছে বাকীর অলস সময় কাটাচ্ছে। আজকালকের প্রজন্মের ছাপার অরে বই পড়ার সময় খুব কম। তাদের বেশীর ভাগ সময় কাটে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটে।
শহীদ রফিক একসময় চলে আসেন গুলশান এলাকায়। রাস্তার পাশে অসংখ্য চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর ফাস্টফুডের দোকান। কি সব বাহারী তাদের নাম, উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে আসে।
বুকে গভীর কষ্ট নিয়ে শহীদ রফিক ফিরে যাচ্ছেন। বিষাদে মন ছেয় আছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। যে দেশে এক সময় ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল ভাষার জন্যে, তাদের দেশের জন্যে, আজও ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে লড়াইয়ে তবে তা দেশের জন্যে নয় হলের সিট দখল করার জন্য। যে দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা শুদ্ধ ভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারেন না, সে দেশ থেকে এর বেশী আর কিছু আশা করার নেই।
খুব লজ্জা নিয়ে শহীদ রফিক ঈশ্বরের কাছে ফিরে যান। উনার দেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কি উত্তর দেবেন?
ঈশ্বর মৃদু হাসেন। ইশারা করেন নীচের পৃথিবীতে। তাকিয়ে দেখ ঐসব ছোট বাচ্চাদের দিকে যারা ফুল নিয়ে এসে ভিড় করেছে শহীদ মিনারে। এরা কোন রাজনৈতিক দলের কেউ না। নোংরা রাজনীতি এখনও এদের স্পর্শ করতে পারেনি। এই প্রজন্ম একসময় বড় হবে। এরা তাদের বুকে লালন করবে ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা। কারণ, সত্যিকারের আত্নত্যাগ কখনও বিফলে যায় না। একে অস্বীকার করবে, এত বড় ক্ষমতা দিয়ে আমি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাইনি।
Thursday, June 5, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment