তিন্নির সাথে আমার প্রথম দেখা এক আর্ট এক্সিবিশনে। চারুকলার ছাত্রী তিন্নি। আর্টের প্রতি তার দারুণ আগ্রহ।
আমার আঁকা একটি মেয়ের ছবির সামনে তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। রক্তে সমস্ত ক্যানভাস ভেসে যাচ্ছে। ওহ মাগো, কি জীবন্ত ছবি-তিন্নি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।
জীবন্ত ছবি আঁকা শিখতে চাও-তিন্নির হাতে আমি আমার ঠিকানা লেখা একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।
এর কয়েক দিন পর তিন্নি আমার বাসায় এসে হাজির। মেধাবী ছাত্রী তিন্নি, খুব দ্রুত শিখতে শুরু করে। তিন্নির চোখে আমি একজন খুব বড় মাপের শিল্পি এবং নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের মানুষ।
আজ বিশেষ একটি দিন। আমি এবং তিন্নি মিলে একটি জীবন্ত ছবির স্কেচ করব।
একেবারে ঠিক সময়ে তিন্নি এসে হাজির, উৎসাহে তার চোখ মুখ ঝলমল করছে। কি জীবন্ত একটি মুখ, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পরমুহূর্তে তিন্নির মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে শুরু করে, দুই চোখে সীমাহীন আতংক এসে ভর করে। আমার হাতে রং-তুলির বদলে চকচকে একটি ক্ষুর। আমি তিন্নির দিকে এগুতে শুরু করি। তিন্নি ক্রমশ পেছাতে থাকে। এক সময় তিন্নির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। আমার দুই চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠে।
তিন্নি আমি ভয়ানক অসুস্থ একজন মানুষ। নরকের কোন এক অন্ধকার জগতে আমার জন্ম। আমার ভেতরের পশুটা আমার চেয়েও শক্তিশালী । আমার ভেতরের পশুটা বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছে, আমি তাকে থামাতে পারছি না। আমাকে মা কর তিন্নি।
রক্তে তিন্নির সমস্ত মুখ ভেসে যাচ্ছে। আমি সেই রক্তে ব্রাশ ডুবিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করি।
এর কয়েকদিন পর।
আমার এক আর্ট এক্সিবিশনে আমার এক ছবির সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইস, কি ভয়ানক আর জীবন্ত ছবি-মেয়েটির চোখে বিস্ময়।
আমি এগিয়ে যাই। মেয়েটি ঠিকই বলেছে, কারণ এটাই তিন্নির আঁকা আমার শেষ ছবি।
এরকম ছবি আঁকা শিখতে চাও?-আমি মেয়েটির দিকে আমার ঠিকানা লেখা কার্ডটি বাড়িয়ে ধরি।
(উসর্গ: শিল্পি ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
আপনি যদি আমাদের দেশের কোন তারকাকে তার কোন প্রিয় শিল্পির নাম বলতে বলেন, তবে তিনি চোখ মুখ নাচিয়ে বলবেন- কেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
শিল্পি জয়নাল আবেদিন বা কামরুল হাসানের নাম তারা বলবেন না।
মাফ করবেন, কারো ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যপারে আমার কোন মতামত নেই।
কিন্তু এর পরপরই সেই তারকা আপনাকে উল্টো প্রশ্ন করবেন-আপনি কি জানেন ভিনসেন্ট কেন বিখ্যাত? তিনি ভালবাসার নিদর্শনস্বরুপ তার প্রেমিকাকে কান কেটে সেই কান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বুঝুন অবস্থা। ভিনসেন্ট যত না তার ছবির জন্যে বিখ্যাত তারচেয়ে বেশী বিখ্যাত কান কাটার জন্যে।
এই কান্ডটা যদি আমি করতাম তবে নির্ঘাত পরদিনই পত্রিকায় আসত এক উন্মাদের কান্ড- শিরোনামে। কিন্তু যেহেতু কান্ডটি ভিনসেন্ট করেছেন তাই এটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে।
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত কিন্তু আমার মতে নিশ্চয়ই এভাবে নয়।
ভ্যান গগের প্রেমিকা (যিনি ছিলেন একজন পতিতা) ছিলেন এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। তাকে শেষ পর্যন্ত আলোর জগতে নিয়ে আসার কোন চেষ্টা ভিনসেন্ট করে ছিলেন কিনা আমার জানা নেই।
বড় মাপের শিল্পিরা বাস্তব জীবনেও বড় মাপের মানুষ হবেন বলে আমরা ধরে নেই। ঈশ্বর সম্ভবত সবাইকে সব মতা দান করেন না। কিন্তু যাদের ঈশ্বর প্রদত্ত সেই মতা আছে তাদের সেই মতা নষ্ট করা উচিত না।)
Thursday, June 5, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment