Tuesday, March 9, 2010

আমি আবার আসিব ফিরে

ফাদার মারিনো রিগন এর জন্ম ইটালির ভেনিসের অদূরে ভিচেন্সার ভিল্লাভেরলা গ্রামে। ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারী কলকাতা হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পথে এ দেশে আসেন। সেই থেকে আজ অবধি বাংলাদেমের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে তিনি ধর্ম প্রচার করে চলেছেন। এখন স্থায়ী ভাবে বাস করছেন সমুদ্রবন্দর মংলা পৌর এলাকার শেলাবুনিয়ায়। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন সাধুপলের গীর্জা। ১০০ টির মত বাংলা বই তিনি ইটালি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তিনি এ দেশে বসবাস করছেন প্রায় ৫৮ বছর ধরে। ২৬ বছর বয়সে তিনি ফাদার পদে অভিষিক্ত হওয়ার দুই বছর পর এ দেশে চলে আসেন।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক গির্জার প্রধান যাজক। দিনের বেলায় গির্জা, রাতের বেলায় তিনি গির্জাটাকে বানিয়ে ফেলতেন হাসপাতাল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফরিদপুর অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমসহ অনেক মুক্তিযুদ্ধাকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন জীবনের ঝুকি নিয়ে।হাজার হাজার শরণার্থী ও মুক্তি যোদ্ধাদের দিয়েছেন আশ্রয়, খাদ্য সবোর্পরি খ্রিস্টীয় মিশনের ছত্রছায়ায় নিরাপদে বিভিন্ন স্থানে পৌছে দেয়ার সুযোগ।


ফাদার মারিনো রিগন ২০০৮ সাল পর্যন্ত বারবার আবেদন করেছেন তাঁকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য অথচ তাঁকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। অবশেষে, ২০০৯ সালে তিনি এ দেশের নাগরিত্ব পান। এর জন্য উনাকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে। কিন্তু তারপরও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ দেশের সন্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রাপ্তিকে তিনি স্মরণ করেন পরম কৃতজ্ঞতার সাথে।


দীর্ঘ ৩৮ বছরে এটা নিয়ে কথা বলার মত কেউকি আমাদের দেশে ছিলেন না? আমাদের দেশে এত সব বুদ্ধিজীবিরা রয়েছেন। যারা স্বাধীনতা, বিজয় দিবসের মাস এলেই ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে টিভি পর্দায় উপস্থিত হন। মুক্তিযুদ্ধের আবেগে উনাদের গলা কাঁপতে শুরু করে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁপতে থাকে টিভি পর্দা। এদের অনলবর্ষী বক্তব্যে কাঁপতে থাকি আমরাও। আফসোস এদের মুখ দিয়ে যে ভাবে আগুন নির্গত হতে থাকে দেখে মনে হয় আহারে লোকটা কেন ড্রাগন হয়ে জন্মাল না।


আমার খালি মনে হয় এটা কি করে সম্ভব হয়। বিদেশী একটি মানুষ কিভাবে একটি দেশকে সেই দেশের মানুষকে এভাবে ভালবাসতে পারেন। এই অসম্ভব হৃদয়বান মানুষটাকে আমরা কি দিয়েছি। এরকম অনেক ফাদার মারিনো রিগন রয়েছেন আমাদের দেশে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে এদের অসামান্য অবদানের কথা জানি না। মুক্তিযুদ্ধের কথা আসলে শিয়ারের কুমিরের বাচ্চা দেখানোর মত করে গুটিকতক মানুষের চেহারাই আমরা বার বার ঘুরে ফিরে দেখি।


ফাদার মারিনো রিগন এর মনে কি এই প্রজন্মের প্রতি কি কোন ক্ষোভের সঞ্চার হয় না। নিশ্চয়ই না। কারণ এই জন্যেই উনার মত মানুষেরা অসাধারণ আর আররা অতি সাধারণ। কি পেলাম আর কি হারালাম তা দেখার জন্য উনার মত মানুষেরা কখনও পেছনে ফিরে তাকান না। না হলে তিনি এভাবে বলতে পারতেন না-
গতবছর তিনি জটিল অপারেশনের জন্য ইতালী যাওয়ার আগে গির্জার লোকজনকে বলে গিয়েছিলেন, ইতালীতে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁকে যেন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়, এখানেই সমাহিত করা হয়।


যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দের ভাষায়- আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়, এই ধানসিঁড়ি নদীর তীরে...।


মাঝে মাঝে মনে হয় একবার গিয়ে দেখে আসি আজ এত বছর পর কেমন আছেন ফাদার মারিনো রিগন নামের ৮৪ বছরের অশিতপর লোকটি। জানি আমার সীমাবদ্ধ জীবনের গন্ডিতে এই কাজটি হয়ত কখনও করা হয়ে উঠবে না।
তারপরও যদি কখনও সুযোগ আসে তাহলে আমি উনার কাছে জানতে চাইব- ফাদার, আপনি আপনার জীবনের শ্রেষ্ট সময়টুকু এই দেশ এই দেশের লোকদের দিয়ে দিয়েছেন। কখনও কি আপনার নিজের দেশ ইতালি, নিজের গ্রাম যেখানে আপনি আপনার শৈশবের শ্রেষ্ট সময়টুকু কাটিয়েছেন, সেই গ্রামের মানুষের জন্য মন কাঁদে না।


হয়ত ফাদার উত্তর দিবেন-মাই সান, আমার মনও তাদের জন্য কাঁদে বৈকি। কিছু চোখের পানি আছে যা দেখা যায়, কিছু আছে দেখা যায় না- এইটুকুই খালি যা পার্থক্য।


তথ্য ঋণ: ১. দৈনিক ইত্তেফাক (০৭.০৩.২০১০)


২. click the link



No comments: