আমির আলির ছেলে আতংকে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে-বাবা জোঁক। আমির আলি তাকিয়ে দেখে তার পায়ে অনেকক্ষণ ধরে একটি জোক প্যাঁচিয়ে আছে। রক্ত খেয়ে একবারে ঢোল হয়ে আছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে আমির আলী অভয়ের হাসি হাসে। ব্যাটা ভয় নাইরে। জমিতে কাজ করতে হইলে এমুন কিছু জোঁকের কামড় সহ্য করতে হয়।
সে টান দিয়ে জোঁকটি পা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। একেবারে কামড় দিয়ে ধরে আছে। অনেক্ষনের চেষ্টার পর ছাড়াতে পারে। ছেলে অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বাবা কত সাহসী।
সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের পর বাপ ছেলে ঘরে ফিরে আসে। এই সময়টুকুর জন্য আমির আলি সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে। বাবুর মা না খেয়ে তাদের দুইজনের জন্য ভাত বেড়ে বারান্দায় বসে থাকবে। তারা সবাই মিলে একসাথে খেতে বসবে। খাবার মাঝে টুকটাক সাংসারিক আলাপ চলবে। আহ, পরিবারের এই ভালবাসার কাছে সারাদিনের ক্লান্তি কত তুচ্ছ হয়ে পড়ে।
ঘরে এসে আমির আলি অবাক হয় অনেক লোকজন দেখে। এরা সব এসেছে ব্যাংক থেকে। পর পর কয়েকটি কিস্তির টাকা বাকী পড়াতে তারা তার গোলা থেকে ধান, ঘরের চালা সব খুলে নিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় শাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বাকী টাকা কালকের মধ্যে শোধ না হলে পুলিশ দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেয়া হবে।
আমির আলি ক্লান্তিতে ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। অনেক দিন ধরে সংসারে টানাটানি যাচ্ছে। যা আয় হয় তার সব টাকাই ব্যংকের কিস্তি শোধ করতেই চলে যায়। এ বছর ভাল ফসল হয়েছে। ভেবে ছিল এবার হয়ত ব্যাংকের টাকা শোধ করে দিতে পারবে। কিন্তু সেই সময়টুকু আর সে পেল না। বাবুর মা বাবুকে কোলে নিয়ে নিরবে কাঁদছে। বারান্দার দাওয়ায় বাড়া ভাত তেমনিই পড়ে আছে।
ছেলে তাকিয়ে দেখে বাবার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে খুব অবাক হয়। তার বাবা কত সাহসী, কত বড় জোঁকটাকে কিভাবে টেনে পা থেকে টেনে ফেলে ছিলেন। তাহলে এই লোকগুলিকে তার বাবা কিছু বলছে না কেন। ধানগুলি সারা বছর ধরে তারা দুইজনে মিলে কত কষ্ট করে গোলায় তুলেছিল। লোকগুলি সব নিয়ে যাচ্ছে।
আমির আলি ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে আজ আর ছেলেকে কোন অভয় বাণী দিতে পারে না। ছেলেকে সে কিভাবে বুঝাবে জমির জোঁক থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কিন্তু এখন সামনে মানুষরূপী যে জোঁকগুলি দাড়িয়ে আছে তাদের হাত থেকে মুক্তির কোন উপায় তার জানা নাই। সত্যিকারের জোঁক কয়েক ফোটা রক্ত খেয়েই থেমে যায়। কিন্তু এই জোঁকগুলি অনবরত মানুষের রক্ত খেয়েই চলে।
ছেলে অনবরত ডেকেই চলেছে-বাবা, ও বাবা। আমির আলি লজ্জায় ছেলের দিকে মুখ তোলে তাকাতে পারছেন না। আজ তিনি জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক ভীতু বাবা।
(স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ১৯৭১ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে তিনি ব্র্যাক, কালক্রমে যা দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থায় পরিণত হয়। দেশের বাইরে এশিয়া এবং আফ্রিকার ৮টি দেশে ব্র্যাক এর কার্যক্রম বিস্তৃত। কাজের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন রেমন ম্যাগসাসে পুরস্কার, ইউএনডিপি পুরস্কার, ক্লিনটন গোবাল সিটিজেন পুরস্কার এবং সবশেষে এ বছরই পেলেন ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে নাইট উপাধি।
আহ্ একটা মানুষের জীবনে এর চেয়ে বেশী আর কিইবা চাইবার থাকে। আমাদের এই সবুজ দেশটাকে বিশ্ব দরবারে তিনি নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
কিন্তু স্যার আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন ব্র্যাক এর শাখাগুলি কর্মীদের জন্য মোটা অংকের বেতন আর ঝা চকচকে জৌলুস নিয়ে কিভাবে বেড়ে উঠছে। একমাত্র উচ্চহারের সুদের কারণেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। ঋণ আদায়ের নামে আপনার লোকেরা দরিদ্র পরিবারগুলির উপর কি পরিমাণ অত্যাচার করে আপনার কি কোন ধারণা আছে।
এর পেছনে যে কত অসহায় পরিবারের কান্না লুকিয়ে আছে তা কি আপনি কখনও অনুভব করেছেন। আপনি কি রাতে একজন সাধারন লোকের মতই ঘুমাতে পারেন। অসহায় মুখগুলি কি দুঃস্বপ্ন হয়ে আপনাকে তাড়া করে ফেরে না। চোখ বন্ধ করলে কি এদের কান্নার শব্দ আপনার কানে ভেসে আসে না।
ধুর কি সব ফালতু সেন্টিমেন্টস নিয়ে কথা বলছি। এতসব দেখলে কি আর আপনার চলবে। আপনার যে এখনও নোবেল প্রাইজ পাওয়া বাকী। দরিদ্র লোকগুলির জীবিত লাশ পাড়ি দিয়ে আপনাকে যে এখনও হাঁটতে হবে অনেক অনেক দূরের পথ। পেছনে ফিরে তাকালে কি আর একজন সফল মানুষ হওয়া যায়।)
Wednesday, March 24, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment