মাঝে মাঝে এই হাসপাতালের চার দেয়ালের ভিতরে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। শাহেদ খুবই যুক্তিবাদী একটি ছেলে। সে কখনও প্রকৃতির মাঝে রহস্য খোঁজার চেষ্টা করেনি। প্রকৃতিতে রহস্য বলে কোন কিছু নেই। তার বিশ্বাস প্রকৃতিতে কোন কিছু এমনিতেই ঘটে না। সব কিছুর পেছনে একটি কারণ রয়েছে। যুক্তির বাইরে কোন কিছুতে সে কখনই বিশ্বাস করে না।
বিশ্বব্রম্মান্ডের কোথাও কি এমন কোন শক্তি লুকিয়ে আছে যা এই মহাবিশ্বের সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার মতে এটা একদমই বাজে কথা। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন একটি বিন্দু থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। তারপর তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে গ্রহ, নক্ষত্র আর সব কিছুর। যদিও এই থিওরি তার মনে জন্ম দিয়েছে অনেক অজানা সব প্রশ্নের। বিগব্যাং এর পূর্বে কি ছিল? প্রাণের সৃস্টি কিভাবে হল? নিজে নিজে যদি প্রাণের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে ল্যাবরেটরিতে কেন আমরা প্রাণ সৃষ্টি করতে পারছি না? তবে তার বিশ্বাস একদিন মানুষ এই সব প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজে বের করে ফেলবে। তখন আর সৃষ্টির রহস্য বলে কোন কিছু থাকবে না।
তার মতে ভাল মন্দের শিক্ষা দেয়ার জন্য ও সৎ জীবন যাপনের জন্য ধর্মগ্রন্থগুলি মানুষই বিভিন্ন সময়ে তৈরী করে গেছে। এখানে যে সৃষ্টিকর্তার কথা বলা হয়েছে তা শুধুই মানুষকে ভয় দেখাবার জন্য। যাতে করে তারা অন্যায় কাজ করতে ভয় পায়।
ধীরে ধীরে শাহেদের জীবন রেখা সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। সে ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছেন। এগিয়ে আসছে মৃত্যু। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষ অমর নয়, মরণশীল। শাহেদেরও তা ভাল করে জানা আছে। মরতেতো হবেই, একদিন আগে আর একদিন পরে।
তারপরও মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। মনে হয় যদি এই বিশ্বব্রম্মান্ডের কোথাও কোন এক সুপার পাওয়ার থাকত, যে সব কিছুই করতে পারত তবে শাহেদ তার কাছে আরও কয়েকটা দিন সময় চাইতে পারত। ধুর, কি সব বোকা আস্তিকবাদীদের মতো সে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছে। সৃষ্টিকর্তা বলতে কোন কিছু নেই। মানুষ তার কল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে তৈরী করে নিয়েছে। সে নিজে একজন ঘোর নাস্তিকবাদী। তাহলে কেন সে এই সব যুক্তি ছাড়া জিনিস কল্পনা করবে। প্রকৃতির সব কিছু তার নিজস্ব নিয়মে চলবে। এখানে কারও ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু যায় আসে না।
আজ বাইরে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি হচ্ছে। শাহেদ হাসপাতালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। নিঃশ্বাসে ভেসে আসছে ভেজা মাটির ঘ্রাণ। গাছের পাতাগুলি সব বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। আহা কত সাধারণ, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কি অপূর্ব একটি দৃশ্য। ইচ্ছা করলেও সে আজ বৃষ্টির পানি ছুতে পারবে না। ক্যান্সার তার সারা শরীরে বাসা বেধে ফেলেছে। এখন সে বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। অনেক চেষ্টা করে তার হাতটুকু সামনে বাড়িয়ে দেয়। সে জানে এতদূর থেকে সে বৃষ্টি স্পর্শ করতে পারবে না। ধপ করে তার হাতটা বিছানার উপর এলিয়ে পড়ে ।
একসময় শাহেদের সব চিন্তা ভাবনা কেমন এলোমেলো হয়ে আসে। মাথায় আবার ভোতা যন্ত্রনা শুরু হয়। নিজের অজান্তেই মনে মনে বলতে থাকে-হে মহাশক্তি, আমাকে একবার শুধু ঐ জানালা পর্যন্ত পৌছার শক্তিটুকু দান কর। প্রাণপন চেষ্টা করে সে উঠে বসে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে জানালার দিকে। অনেক দিন পর আজ সে উঠে দাঁড়াতে পারছে। আরেকটু, তাহলেই সে পৌছে যেতে পারবে। অবশেষে সে পৌছতে পারে। শাহেদ চমকে উঠে। তাহলে কি কোন অদৃশ্য শক্তি তার মনের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। শাহেদ হাত বাড়িয়ে দেয় জানালার বাইরে। কত দিন পর আজ বৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করছে। আহ্ কি শান্তি। শাহেদের দুই চোখ ভিজে আসে। হায়! বেঁচে থাকা এত আনন্দের কেন।
ইস্ এখন যদি কোন মিরাকল ঘটত। ঐশ্বরিক কোন শক্তির কল্যাণে সে যদি হঠাৎ করে ভাল হয়ে যেত। তবে কি তার এত দিনের বিশ্বাসে চিড় ধরতে আরম্ভ করেছে। শাহেদ মাথা থেকে এ ধরণের চিন্তা সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। ঈশ্বর বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এ সব শুধুই মানুষের অবচেতন মনের কল্পনা। কিন্তু শাহেদের চোখ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে কি যেন খোঁজে ফিরে। আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় দূরে, আরো দূরে। এই বিশ্বব্রম্মান্ডের কোথাও কি তাহলে লুকিয়ে রয়েছে এমন কোন ঐশ্বরিক শক্তি বা ঈশ্বর যিনি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। যার জাদুর স্পর্শে সব কিছু বদলে যেতে পারে।
শাহেদ চোখ বন্ধ করে ফেলে। ফিস ফিস করে বলতে থাকে-হে অজানা ঐশ্বরিক শক্তি, আমাকে আর কয়েকটা দিনের আয়ু দান কর। আমি এই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর কয়েকটি দিন দেখে যেতে চাই।
শাহেদ মারা যায় এর কিছুক্ষণ পরই । একজন ক্যান্সার আক্রান্ত লোকের স্বাভাবিক মৃত্যু। কোন মিরাকল ঘটেনি । প্রকৃতিতে সব কিছু তার মত করে ঘটে। প্রকৃতি তার সব রহস্য মানুষের কাছে প্রকাশ করে না। স্রষ্টা সব সময় তার সৃষ্টি নিজের মত করে পরিচালনা করেন। স্রষ্টা তার সব ক্ষমতা মানুষকে দেখাতে পছন্দ করেন না।
(আমি সব সময় দুইটা বিষয় সযত্নে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক বির্তক, অপরটি ধর্মীয় বির্তক। দুটি ক্ষেত্রেই লোকজন খুব আক্রমণাত্নক হয়ে উঠে। মুহুর্তেই পক্ষে বিপক্ষে দুটি দল তৈরী হয়ে যায়।
আমি কোন বির্তক করার জন্য এই পোস্ট দিচ্ছি না। আমার কথা হচ্ছে মতভেদ থাকতেই পারে। সেই পুরনো কৌতুকের কথা মনে পড়ছে।
জজ আসামীকে বলছেন- তোমাকে অন্তত ৫ জন লোক চুরি করতে দেখেছে।
আসামী উত্তর দিচ্ছে-স্যার, আমি অন্তত ৫০ জনকে এই কোর্টে হাজির করতে পারব যারা আমাতে চুরি করতে দেখেনি।
পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি পাল্টা যুক্তি থাকবেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই রয়েছে। প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব দর্শন । আমি আমার দর্শন অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আমার দর্শন সাদরে গ্রহণ করছে।
আমরা বিজ্ঞানের মতবাদ বিশ্বাস করি না। আবার পরক্ষণেই জানতে চাই- আকাশ কেন নীল।
আমরা সৃষ্টি কর্তায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন বিপদে পড়ছি, তখন আবার সেই সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রার্থনা করছি আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।
এখানে দুইটাকেই পাশাপাশি চলতে দেয়া যায়। একটিকে অপরটির প্রতিপক্ষ ভাবার কোন কারণ নেই। বিজ্ঞান হোক আর ধর্মই হোক প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতবাদ রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব যুক্তি। আমার মতবাদই ঠিক, তোমারটা ভুল এমন ভাবার কোন কারণ নেই। প্রতিনিয়তই আমরা নতুন কিছু শিখছি। তারপরও কি কেউ দাবী করতে পারবেন যে তিনি সৃষ্টির সমস্ত রহস্য জেনে বসে আছেন। এখন পর্যন্ত এই বিশ্বব্রম্মান্ডের সব কিছুর ব্যখা কি মানুষ আদৌ করতে পেরেছে। যদি না পারে তবে সেই দিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যেদিন আমরা বলতে পারব সৃষ্টির রহস্য বলতে আসলে কোন কিছু নেই। তার আগে তোমার ধর্ম অযৌক্তিক আর আমার বিজ্ঞান যুক্তি সম্পন্ন এমন বলার কোন অধিকার আমার নেই।)
Tuesday, April 7, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment