Monday, September 29, 2008

ঈদ বিনোদন

ঈদ আসন্ন। টিভি চ্যানেলগুলি আমাদেরকে এরিমধ্যে বিরক্তির চুড়ান্ত সীমায় পৌছে দিয়েছে। তারকারা ইনিয়ে বিনিয়ে প্রতি মুহুর্তে বলে যাচ্ছেন ঈদে টিভিতে কার কি প্রোগ্রাম দেখাবে। একদল কি সব আজগুবি ঈদ স্পেশাল রেসিপি নিয়ে এসে হাজির হচ্ছেন। খেয়ে নিজেই প্রশংসা করছেন খুব ভাল রান্না হয়েছে। আরেক দল আছেন তারা কয়েকজন মিলে নিজেদের মধ্যে অলোচনা করতে বসে যান। তাদের ছেলে বেলার ঈদ কেমন ছিল এখন কেমন, সারাদিন কিভাবে কাটিয়েছেন, ঈদে কি পোষাক নিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। একেক জন নিজের ছেলে বেলার ঈদের বর্ণনা দিচ্ছেন আর কোন মজার ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন। তারপর আছে আরেক দল তারা কে কোন নাটকে, কে কোন সিনেমায় অভিনয় করেছেন তা আমাদেরকে ঘটা করে জানাচ্ছেন। তারপর সেই সিনেমা বা নাটকের কাহিনীর ফিরিস্তি শুরু হয়ে যায়। আপনি শুনতে না চাইলেও আপনাকে শুনতে হবে। আর আছে বিঞ্জাপনের যন্ত্রনা। সমস্ত কোম্পানীগুলি আপনাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করে দেবে। এ থেকে আপনার রেহাই নেই। নীচে তেমনি একজন ফিল্ম স্টারের টিভি সাক্ষাতকার প্রচার করা হল-

ঈদে এবার ঢালিউড থেকে আমার একটা মাত্র ছবিই মুক্তি পাচ্ছে। নামটা খুবই সুন্দর ‘‌কদম আলী কেন ঝাড়ুদার’। খুবই বেতিক্রমধর্মী একটা ছবি। এখানে আমার চরিত্রটা হচ্ছে একজন ঝাড়ুদারের। যে প্রতিদিন সকালে ঝাড়ু নিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর সে শহরের রাস্তা ঝাড়ু দিতে শুরু করে। ডাইরেক্টার এখানে খুবই সুন্দর ভাবে আমার চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। একেকটা ঝাটার বাড়িতে আবর্জনা কি সুন্দর ভাবে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।

তারপর আমি কদম আলী আমার একসময় প্রেম হয় শহরের মেয়রের মেয়ের সাথে। তবে এই ছবিটার কাহিনী আর দশটা ছবির প্রেম কাহিনীর মত না। মেয়রের মেয়ে একদিন আমাকে জিন্স-টি শার্ট পড়ে রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখে ফেলে। আমার ঝাড়ু দেয়ার দক্ষতা দেখে সে মুগ্ধ হয়। আমাকে তাদের বাড়ীতে ঝাড়ুদারের চাকরী অফার করে। অনেক পীড়াপিড়ীর পরে আমি রাজী হই। আমি নীচে লনে তাদের বাড়ী ঝাড়ু দিতাম আর উপর থেকে সে তাদের বাড়ীর জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমাদের চোখে চোখে কথা বলা শুরু হয়। তারপর মোবাইলে এফ এন এফ নাম্বার এর মাধ্যমে কথা বলা শুরু। তারপর চলে ইন্টারনেট চেটিং। আপনারা হয়তো ভাবছেন একজন ঝাড়ুদার এত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছে। সেই চিন্তা আমার না, প্রযোজকের। বাংলা ছবিতে সবই সম্ভব। ধীরে ধীরে এক সময় আমাদের প্রেম কাহিনী পূর্ণতা লাভ করে।

তারপরই মুরু হয় ক্লাইমেক্সের। মেয়র সাহেব জেনে যান আমাদের প্রেম কাহিনী। একদিন নায়িকা জরিনা বিবিকে নিয়ে আমি পাহাড়ের উপরে উঠে গলা ছেড়ে গান গাচ্ছিলাম। নায়িকা ঐ সময় আমার কাধের উপরে ছিল। নায়িকা খুব ভারী হওয়াতে আমি বেলেন্স ঠিক রাখতে পারিনি। নায়িকাকে নিয়ে ধড়াম করে পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে যাই। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ী এসে অতি কষ্টে আমাদেরকে উদ্ধার করে।

তারপরতো বুঝতেই পারছেন, নায়িকা তার বাবার হাতে বন্দী হয়ে পড়ে আর নায়িকার বাবা আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে আমার পেছনে কুকুরের মতো গুন্ডা লেলিয়ে দেন। নায়িকা দিনরাত প্রতিবাদের গান গাইতে থাকে আর আমি এক এক করে সমস্ত বাধা টপকে যেতে থাকি। শেষ পর্যন্ত কিভাবে ভিলেন বাবার হাত থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে আমাদের মিলন হয় তা জানতে হলে আপনাদেরকে সপরিবারে হলে এসে এই মিষ্টি প্রেমের সুন্দর রোমান্টিক ছবিটি অবশ্যই দেখতেই হবে। সেন্সর বোর্ড যদিও দুই একটা আপত্তিকর দৃশ্যের কারণে ছাড়পত্র দিচ্ছে না। আরে ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট চ্যানেল সেখানে এই সামান্য কারণে ছবি আটকে দিতে হবে। সেন্সর বোর্ড কবে এডাল্ট হবে। আমরা কিন্ত মানব না, শেষ পর্যন্ত ঠিকই ছাড়পত্র বের করে আনব। কত বড় বড় ক্রিমিনাল ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে আর এতো সামান্য একটা ছবি।

তবে পরিবার নিয়ে আসলে আগেভাগে একটু খোজ নিয়ে আসবেন, কোন হলে কাটপিস বিহীন ছবি প্রর্দশিত হচ্ছে। নইলে বুঝতেইতো পারছেন ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে।

(উপরের সাক্ষাতকারটি সম্পূর্ন কার্ল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে কোন সম্পর্ক নেই।)

Sunday, September 14, 2008

চুক্তি

সিংহ যখন তখন বনের পশুদের ধরে খেয়ে ফেলে। সবাই মিলে সিংহের কাছে আরজি নিয়ে গেল-হুজুর আপনি প্রতিদিন কেন কষ্ট করে শিকার ধরবেন আমরাই আপনার কাছে প্রতিদিন একটা করে নাদুস নুদুস দেখে পশু পাঠিয়ে দেব আর আপনি মজা করে খাবেন আর কটমট করে হাড় চিবাবেন।

সিংহ দেথল মন্দ নয় বিনা পরিশ্রমে এভাবে খাবারের যোগান পাওয়া গেলে চিন্তা কি। বসে বেসে থবরের কাগজ পড়া, সারাদিন ঘুম আর খাওয়া। সিংহ বলল-তথাস্তু।

বনের পশুরা চিন্তা করে দেখল এতে করে যখন তখন সিংহের অত্যাচার থেকে সাময়িক রেহাই পাওয়া গেল । অনেকটা মন্দের ভালো।

এভাবে কিছুদিন গেল। তারপর যেই আলু সেই চপ। সিংহের অত্যাচার আরো বেড়ে গেল।

বনের পশুরা আবার গেল সিংহের কাছে। শিয়াল মিনমিন করে বলতে শুরু করল- হজুর আপনার সাথে তো আমাদের সম্ভবত একটা চুক্তি হয়েছিল আপনি যখন তখন বনের পশুদের খাবেন না, কিন্তু এখনতো দেখছি আপনি চুক্তি বাতিল করছেন।

‌খামোশ বেয়াদব- সিংহ গরজে উঠল। আমি বনের রাজা আমি যখন ইচ্ছে চুক্তি বাতিল করতে পারি।

এবার শিয়াল পুনরায বলে উঠল- কিন্তু হুজুর চুক্তি বাতিলের তো কোন একটা কারণ থাকে। আমরা প্রতিদিন যে একটা করে পশু আপনার খাওয়ার জন্যে পাঠাচ্ছি এতে করে কি আপনার পেট ভরছে না, তা হলে রোজ দুইটা করে পাঠিয়ে দেই।

এবার সিংহ একটু নরম হয়ে বলল- নারে আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। এভাবে বসে বসে রোজ শিকার খেতে আর ভালো লাগছে না। এতে আগের সেই মজা নেই। শরীরে অলসতা এসে ভর করছে। শিকারের পেছনে ধাওয়া করে তার ঘাড় মটকানো, ঘ্যাচ করে তার ঘাড়ে দাত বসিয়ে দেয়ার যে আনন্দ এখানে সেই মজা কোথায়। প্রাণ ভয়ে একটা শিকার পালাচ্ছে আর আমি তার পেছনে ধাওয়া করে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ছি, এটা ভাবতেই আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। খালি পেট ভরে কি হবে, জীবনে যদি কোন রোমাঞ্চই না থাকে।
অতএব আবার সব আগের নিয়মেই চলবে। চুক্তি-ফুক্তি সব হাওয়া।

(বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে তার সাথে বাড়ছে আমাদের দেশের খবরের কাগজের্ উষ্ঞতা। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা খুললেই চমকপ্রদ সব খবর। এতদিন আমরা প্রায় ভুলতে বসে ছিলাম আমাদের সেই সব জনদরদী নেতাদের কথা, তাদের জ্বালাও পোড়াও সব আন্দোলনের কথা।

হরতাল, ভাঙচুর ছাড়া আর ভালো লাগছিল না। এবার হয়তো একটা কিছু হতে যাচ্ছে। কি হবে সব চুক্তি করে আর শর্ত আরোপ করে। কদিন বাদেই সব হাওয়া। অতএব আবার সব আগের মতোই চলবে। কারণ এটা আমাদের রক্তের সাথে মিশে রয়েছে। একে বদলাবে- কার বাপের সাধ্য।

Wednesday, September 10, 2008

উপদেশ

এক লোকের বাসায় চুরি হল। েচার সব মালসামান নিয়ে গিয়ে যাবার সময় একটি চিরকুট রেখে গেল- ‘আপনার জানালার শিকগুলি খুব বেশী মজবুত নয়, আমি সেখান দিয়েই ঢুকেিছ।
গৃহকর্তা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে েচারের উপদেশ মেনে নিলেন। জানালায় নতুন শিক লাগানোর ব্যবস্থা করলেন। কিছু দিন পর ঐ বাড়ীতে আবার চুরি হল। যখারীতি েচার এবারো চিরকুট রেখে গেল-‘আপনার দরজার তালাটি খুবই দুর্বল বিধায় আমি এবার সেখান দিয়েই প্রবেশ করেছি।
গৃহকর্তা দরজার পুরনো তালা বদলে নতুন তালা লাগালেন। এর কিছু দিন পর কুরিয়ারে উনার নামে একটি চিঠি আসল। পত্রলেখক সেই েচার মহাশয়।
পত্রে েলখা-‘আমার ধারনা ছিল না আপনি আমার উপদেশকে এতো গুরুত্বের সহিত নেবেন্ এবার আর আমি আপনার বাড়ীতে ঢুকতে পারিনি।

Sunday, August 24, 2008

ডেডলাইন ২০২৫

সন ২০২৮, আজ হতে প্রায় ২০ বছর পর। গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মুহম্মমদ ইউনুস দুই মহারথীকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন জাদুঘর পরিদর্শনে। উনার একপাশে সাবেক ফার্স্ট লেডী হিলারী ক্লিনটন অপর পাশে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী (কুচক্রী) কন্ডোলিনা রাইস। এতো দিনে হিলারীর সৌন্দর্য অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেছে। অধিকাংশ চুলে পাক ধরেছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। কন্ডোলীনার মুখের চামড়া টামড়া কুচকে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। তবে দুই চোখের ধূর্ততা বিন্দু মাত্র কমেনি। ড. ইউনুসের চুল সব সাদা হয়ে গেছে। মুখে বয়সের বলিরেখা ফুটে উঠেছে। তবে উনার মুখের হাসি এখনো অমলিন রয়েছে। হিলারী আর রাইস যাই দেখছেন তাতেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন।
এবার ড. ইউনুস তাদের নিয়ে আসলেন যাদুঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে। এখান এক কোনায় খলি গায়ে কিছু হাড় জিরজিরে লোক মাথা নিচু করে বসে আছে। হিলারী আর রাইস দু’জনেই বিস্মিত হয়ে ড. ইউনুসের দিকে তাকালেন। ড. ইউনুস মুখে সেই বিখ্যাত হাসি ফুটিয়ে বিজয়ীর ভংগিতে বললেন, আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ ছিল ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দারিদ্রতা জাদুঘরে এসে ঠাই নেবে। দেশে কোন দরিদ্র লোক থাকবে না। আর আপনারা এর নমুনাতো দেখতেই পাচ্ছেন। এ হচ্ছে আমাদের দেশের দারিদ্রতা। সবাই বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে সুখে জীবন যাপন করছে।
এদের মধ্য থেকে সবচেয়ে দুর্বল লোকটি কাপতে কাপতে উঠে দাড়াল। লোকটার কোমরে শুধুমাত্র গ্রামীণ চেকের একটি গামছা জড়ানো। লোকটি কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম দেয়ার ভঙ্গি করল।
হিলারী, রাইস দু’জনেই বাঙ্গালীদের ভদ্রতা দেখে মুগ্ধ হলেন।
জাদুঘর পরিদর্শন শেষে ড. ইউনুস তাদেরকে গাড়ীতে উঠিয়ে দিতে গেলেন। পেছন থেকে কে যেন ‘ইউনুস ভাই’ বলে ডেকে উঠল। বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন একটু আগে দেখা লোকটি ছুটে আসছে। সামনে এসেই লোকটি অভিযোগের ভঙ্গিতে বলতে আরম্ভ করল- ‘আমারে বলছে এক ঘন্টার জন্যে দুই হাজার টাকা দেয়া হইব, এখন কয় এক হাজার দিব। কতক্ষণ ধইরা এই কোনাতে বইসা রইছি। বলে এক ঘন্টা নাকি হয় নাই। আমি এফ.ডি.সি থাইকা ‘চাকরের কসম’ ছবির চাকরের পার্ট ফালাইয়া আইছি। এইডা কোন বিচার‌।‌’
ড. উইনুস দাত কিড়মিড় করতে লাগলেন, অপদার্থ সেক্রেটারিটা একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারে না। তাকে বলা হয়েছিল কিছু বিদেশী মেহমান আসবেন জাদুঘর পরিদর্শনে, তাদের দেখানোর জন্যে কিছু লোক ভাড়া করে জাদুঘরে আনার জন্যে। এখন কি ঝামেলাতে পড়া গেল।
হিলারী, রাইস বাংলা না জানার জন্যে এদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছেন না। হিরারী জিঙ্গেস করলেন, ‘এনিথিং রং ড. ইউনুস?’
ড. ইউনুস দ্রুত সামলে উঠলেন- ‘নো, নো ইটস নাথিং।’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে লোকটির হাতে দু’টা পাচশত টাকার নোট গুজে দিলেন।
রাইস এত সহজে ছাড়ার পাত্রী নন। ভ্রূ কোচকে জানতে চান -‘আপনি লোকটাকে কিসের টাকা দিচ্ছেন?’
ড. ইউনুস হা হা করে হেসে উঠলেন। বুঝলেন না লোকটা আমাদের মাইক্রো ক্রেডিট পলিসি গ্রহন না করে এখন পস্তাচ্ছে। গ্রামীন ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার জন্যে আমার পেছনে পেছনে আসছে।
‘সো?’- রাইস নির্লিপ্ত ভাবে জানতে চান?
‘ভেরী পুওর ম্যান, লোনের ফরম কেনার মতো টাকাও তার কাছে নেই। তাই আমি লোকটাকে ফরম কেনার টাকা দিয়ে আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসে যোগাযোগ করতে বলেছি।’
এবার রাইস সন্তষ্ট হলেন- ‘আই সি। আপনার গ্রামীণ ব্যাংক এর মধ্যে অনেক ডেভেলপ করে ফেলেছে। বর্তমান যুগ হচ্ছে মোবাইল সিস্টেমের যুগ। আর আপনি পকেটেই লোনের টাকা নিয়ে ঘুরছেন। ভেরি ইন্টারেস্টিং। দেখি আমাদের দেশেও এই সিস্টেম চালু করা যায় কিনা। তাহলে আমরাও আপনাদের মতো শীঘ্রই ধনী দেশে রুপান্তরিত হতে পারব।
হিলারী, রাইস দু’জনেই এবার বিদায় নিলেন। ড. ইউনুস পেছনে দাড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগলেন।

( নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুস এই একটি মাত্র পরিচয়ই উনার জন্যে যথেষ্ট, এর বেশী আর কোন পরিচয়ের দরকার নেই। এর মাধ্যমে তিনি বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশকে পরিচিত করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক আমাদের দেশে প্রচুর কাজ করছে । কিন্ত এই ব্যাংক দরিদ্র মানুষকে চড়া সুদে লোন দিচ্ছে, আবার লোনের টাকা পরিশোধ না করতে পারলে তাদের কর্মীরা কৃষকের গোলার ধান, হাস মুরগি, ঘরের টিনের চাল খুলে নিয়ে আসছে। এমনকি কৃষকের বউ এর কানের দুল, মেয়ের পায়ের নূপুর পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে। এতে করে অনেক দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে, ঘটেছে আত্নহত্যার মতো ঘটনা।
হয়ত এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা বলবেন, বড় কিছু করতে গেলে ছোট খাট কিছু সমস্যা দেখা দেবেই। একশ ভাগ ঠিক কাজতো আর কার সম্ভব নয়।
ঠিক আছে মানলাম, কিন্ত তা যদি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে পৌছে তাহলে তা আবশ্যই বর্জনীয়। কারণ লোন দেয়ার আগে দেখা উচিত যাকে লোন দেয়া হচ্ছে তার চড়া সুদে ঐ লোন নেয়ার মতো সার্মখ্য আছে কিনা। এবং ঐ টাকা যদি সে পরিশোধ না করতে পারে তবে পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ড. ইউনুস এর ছেলে মেয়েরা সম্ভবত দেশের বাইরে পড়াশুনা করে, উনি নিশ্চয়ই প্রতিদিন বাজারে যান না। যার জন্যে উনার পক্ষেই বলা সম্ভব ২০২৫ সাল নাগাদ আমাদের দেশে দারিদ্রতা জাদুঘরে ঠাই পাবে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা। সেখানে এ ধরনের মন্তব্য করে মানুষের কষ্টকেই শুধু বাড়ানো হচ্ছে।
তবে হ্যা উনার এই স্বপ্ন অবশ্য এক দিক দিয়ে সত্যি হবার সম্ভবনা আছে।
কারণ এই ভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ ব্যয়বহুল খরচের চাপে পড়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি এমনিতেই মরে সাফ হয়ে যাবে। বেচে থাকবে শুধু কিছু সংখ্যক ধনী জনগোষ্ঠি। যে কয়জন দরিদ্র লোকজন তখন পর্যন্তও কই মাছের প্রানের মতো বেচে থাকবে তাদেরকে ধরে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিলেই হবে।)

Thursday, June 5, 2008

পাঠকের কাঠগড়ায়

ঈশ্বরের বিচার সভা। বিচারের কাঠগড়ায় দাড়ানো একজন মানুষ। স্বর্গ এবং নরকের দেবদূতরা নিজ নিজ পক্ষের যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করছেন।
স্বর্গের দেবদূত: মাই লর্ড, এই লোককে অবশ্যই স্বর্গে পাঠানো উচিত। জীবিত অবস্থায় এই লোক একজন লেখক ছিল। এই লোক তার লেখনি দিয়ে অনেক লোককে হাসিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে। সে মারা গেছে কিন্তু তার লেখা এখনও জীবিত রয়েছে। যা দ্বারা মানুষ তার মৃত্যুর পরও তাকে মনে রাখবে, তার লেখা পড়ে আনন্দ পাবে। তার মৃত্যুর পরে অনেক ভক্ত কান্নাকাটি করেছে। অনেক মানুষের শুভ কামনা রয়েছে তার জন্যে । অতএব এমন জনদরদী একজন লোকের জন্যে স্বর্গই উপযুক্ত স্থান হওয়া উচিত।

নরকের দেবদূত: মাই লর্ড, আমি আমার প্রতিপক্ষের সাথে একমত হতে পারছি না। এই লেখক ভদ্রলোক তার লেখা দিয়ে অনেক মানুষকে কাঁদিয়েছে, অনেককে রাগিয়েছে। অনেকের মনে দুঃখ দিয়েছে। সে মারা গেছে কিন্তু তার অত্যাচার বন্ধ হয়নি, কারণ তার লেখা এখনও বেঁচে রয়েছে। তার মৃত্যুর পর এখন থেকে তাদের আর জঘন্য সব লেখা পড়তে হবে না ভেবে অনেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে । এখনও লোকজনের বিতৃষ্ণা তার উপর বর্ষিত হচ্ছে। এমন একজন বিতৃষ্ণা উৎপাদনকারী লোকের জন্যে নরকই উপযুক্ত স্থান হওয়া উচিত।

ঈশ্বর পড়লেন খুব সমস্যায়, দুই পক্ষের বক্তব্যেই যুক্তি আছে। শেষ পর্যন্ত যম দূতকে খবর পাঠালেন। এই লোককে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠানো হবে। কিছুদিন তাকে অবর্জাবেশনে রেখে দেখা হবে, তার জন্যে স্বর্গ না নরক কোনটা উপযুক্ত হবে।

এতক্ষণ লোকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার হাত জোর করে বলে উঠে, মহামাণ্য আমাকে যদি পুনরায় পৃথিবীতে পাঠাতে চান তবে দয়া করে লেখক বানিয়ে পাঠাবেন না। কারণ পাঠকের কাঠগড়া আপনাদের এই কাঠগড়ার চেয়েও ভয়াবহ। যা আমি জীবিত অবস্থায় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। লেখকের কোন লেখা ভাল লাগলে পাঠকরা তাকে মাথার উপর বসিয়ে রাখবে আর দুঃভাগ্যক্রমে কোন লেখা মনঃপুত না হলে তাকে নর্দমায় ছুড়ে ফেলবে। লেখকেরা যেন মানুষ নয় লেখা ছাপানোর মেশিন। এদের জন্মই হয়েছে মানুষকে অনন্দ দেবার জন্যে। যেন লেখকের নিজস্ব কোন ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অনুভুতি থাকতে পারে না।

অতএব আমার বিনীত প্রার্থনা হচ্ছে, আমাকে গাধা-খচ্চর যা খুশি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠান আমার আপত্তি নেই, কিন্তু দয়া করে পুনরায় লেখক বানিয়ে পাঠাবেন না।

আমাদের প্রজন্ম

ভাষা শহীদ রফিকের আবেদন ঈশ্বর শেষ পর্য়ন্ত মঞ্জুর করেন। এক দিনের জন্যে তিনি বাংলাদেশ দেখে যাবেন। যে ভাষার জন্যে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সে ভাষার এতদিনে কতটুকু উন্নতি ঘটেছে তা দেখাই উনার উদ্দেশ্য।
প্রথমেই তিনি চলে আসেন বাংলা একাডেমিতে। এখন সেখানে বই মেলা চলছে। মেলার গেইটে পাঠকের দীর্ঘ লাইন। প্রশান্তিতে শহীদ রফিকের বুক ভরে যায়।
মেলায় প্রবেশ করেই তিনি ভ্যবাচেকা খেয়ে যান। সম্ভবত ভুল করে তিনি কোন কমিউনিটি সেন্টারে চলে এসেছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। চারদিকে হলুদ পাঞ্জাবি পড়া ছেলে আর হলুদ শাড়ী পড়া মেয়েদের ছড়াছড়ি। সম্ভবত এরা বর পরে লোকজন। কিন্তু সবাই একই রঙের এতগুলি পোষাক কোথা থেকে যোগাড় করেছে। স্টেজে বর কনে সেজে বসে আছে, পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
এটা কি ধরণের বিয়ে রে বাবা- শহীদ রফিক বুঝতে পারেন না। একটু খোঁজ করতে গিয়ে উনার ভুল ভাঙে। এখানে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। দেশের একজন প্রখ্যাত লেখকের বই এর পাবলিসিটি চলছে।
গভীর বেদনা নিয়ে শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। সবাই লাইন দিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বই কিনছে। বাচ্চারা কিনছে ভূত-পেত্নীর বই। এক সময় এই বাচ্চারা বড় হবে ভূত-পেত্নীদের সাথে নিয়ে। যে ভাষায় তারা কথা বলছে সেই ভাষার পেছনে যে আমাদের এক গৌরবময় ইতিহাস জড়িত এটা তাদের জানানোর চেষ্টা কেউ করছে না। তাদের জন্যে এ ধরনের তেমন কোন বইও নেই। শহীদ রফিক মন খারাপ করে মেলা থেকে বেরিয়ে যান।
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন শহীদ মিনার চত্বরে। যেখানে এক সময় এই ভাষার জন্যে উনার মতো আরও অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। চারদিকে নোংরা কাগজপত্র পড়ে আছে। ঝাড়ু– দেয়ার কেউ নেই। খালি কয়েকজন ফেরিওয়ালা ঘোরা ফেরা করছে। শুধু মাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২ টার পর থেকে এখানে লোকজনের ঢল নামে। খালি পায়ে কার আগে কে গিয়ে শহীদ মিনার চত্বরে ফুল দিবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
এবার তিনি চলে আসেন দেশের এক নামকরা প্রইভেট ইউনির্ভাসিটিতে। এখানকার ছেলে মেয়েরা বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে এক অদ্ভূত ভাষায় কথা বলছে। এ নতুন ভাষা তারা কোথা থেকে আমদানি করেছে তিনি বুঝতে পারছেন না। সময়ের সাথে দেশের পরিবর্তন ঘটতে শুনেছেন, তার সাথে কি ভাষারও এত পরিবর্তন ঘটে তিনি জানেন না। এখানকার ছেলে মেয়েদের কাছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে চাওয়া রীতিমতো দুঃসাহসের ব্যপার। কারণ এরা ডিজুস নামক এক নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়ে। তিনি এই প্রজন্মের সাথে পরিচিত নন।
শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। এবার তিনি চলে যান পাবলিক লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে প্রচুর বই, কিন্তু পড়ার লোক নেই। কিছু পাঠক আছে । এর মধ্যে কয়েকজন পড়ছে বাকীর অলস সময় কাটাচ্ছে। আজকালকের প্রজন্মের ছাপার অরে বই পড়ার সময় খুব কম। তাদের বেশীর ভাগ সময় কাটে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটে।
শহীদ রফিক একসময় চলে আসেন গুলশান এলাকায়। রাস্তার পাশে অসংখ্য চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর ফাস্টফুডের দোকান। কি সব বাহারী তাদের নাম, উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে আসে।
বুকে গভীর কষ্ট নিয়ে শহীদ রফিক ফিরে যাচ্ছেন। বিষাদে মন ছেয় আছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। যে দেশে এক সময় ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল ভাষার জন্যে, তাদের দেশের জন্যে, আজও ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে লড়াইয়ে তবে তা দেশের জন্যে নয় হলের সিট দখল করার জন্য। যে দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা শুদ্ধ ভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারেন না, সে দেশ থেকে এর বেশী আর কিছু আশা করার নেই।
খুব লজ্জা নিয়ে শহীদ রফিক ঈশ্বরের কাছে ফিরে যান। উনার দেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কি উত্তর দেবেন?

ঈশ্বর মৃদু হাসেন। ইশারা করেন নীচের পৃথিবীতে। তাকিয়ে দেখ ঐসব ছোট বাচ্চাদের দিকে যারা ফুল নিয়ে এসে ভিড় করেছে শহীদ মিনারে। এরা কোন রাজনৈতিক দলের কেউ না। নোংরা রাজনীতি এখনও এদের স্পর্শ করতে পারেনি। এই প্রজন্ম একসময় বড় হবে। এরা তাদের বুকে লালন করবে ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা। কারণ, সত্যিকারের আত্নত্যাগ কখনও বিফলে যায় না। একে অস্বীকার করবে, এত বড় ক্ষমতা দিয়ে আমি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাইনি।

উড়ে যায় বলাকা

মা তার বাচ্চাকে কোল নিয়ে খুব আগ্রহ করে তাকিয়ে আছে। সামনে ছেলের বাবা পশু জবাই করছে। অসহায় একটি পশুকে বেঁধে ফেলে গলায় ছুরি চালানো হচ্ছে। পশুটির দু চোখে বেঁচে থাকার সীমাহীন আকুতি।
বোবা প্রাণীটি সম্ভবত বলতে চায়, আমরা নির্বোধ পশু কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন।
কাটা গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে বাবার সমত্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে। গলা কাটা পশুটি ব্যথার যন্ত্রনায় ছটফট করছে। এক সময় পশুটির সমত্ত দেহ নিথর হয়ে আসে।
বাবার চোখে বিজয় আনন্দের উল্লাস। মার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এই দৃশ্য দেখে এক সময় তার ছেলেও বাবার মতই সাহসী হবে। ছেলের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু তার অবচেতন মনে ঠিকই সম¯ত্ত ঘটনাটি গেঁথে যায়।

২৫ বছর পর নির্জন এক রাস্তায় ছেলেটি এক নিরীহ লোককে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। লোকটি দেশের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। ছেলেটির তা জানার কথা নয়। জানার কোন মাথা ব্যথাও তার নেই। ছোট বেলায় দেখা এমনই একটি কাছাকাছি ঘটনার স্মৃতি ছেলেটির অবচেতন মনে ছায়া ফেলে। ছেলেটি ঠিক মনে করতে পারে না। মনে করার তার সময়ও নেই। খুব দ্রুত কাজ শেষ করে তাকে চলে যেতে হবে।
লোকটির দু চোখে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি। উনিতো করো কোন ক্ষতি করেননি, তাহলে কেন উনার প্রতি পশুর মতো এমন একটি আচরণ করা হচ্ছে। বিড় বিড় করে বলতে চেষ্টা করেন, হে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন।

সীমাহীন স্বচ্ছ নীল আকাশে একটি বলাকা উড়ে যাচ্ছে। নীচে রাজ পথে পড়ে আছে এ দেশেরই এক সাংবাদিকের রক্তাত দেহ। যিনি এক সময় দেশের জনগনের জন্যে কলম তুলে নিয়েছিলেন। উনার কলমের কালি এক সময় দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে। আজ উনার রক্তেই দেশের জনপদ স্নাত হচ্ছে।

মোবাইল ফোন

দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় মোবাইল কোম্পানীর গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। চোদ্দ কোটির দেশে শুধু একটি কোম্পানীর গ্রাহক সংখ্যাই এক কোটি। কে বলে আমাদের দেশ গরীব। ঐ মোবাইল কোম্পানীটি আমাদের দেশকে এক দশকে কোথায় পৌছে দিয়েছে এটা তারা বেশ ফলাও করে প্রচার করছে। মোবাইল ফোন আসার পর দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু মোবাইল কোম্পানীগুলি গ্রাহকের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজেদের স্বার্থ দেখতেই বেশী ব্যস্ত থাকে।
একবার এক দৈনিক পত্রিকা দেশের কিছু বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি কাল্পনিক গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। যার বিষয়বস্তু ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোনের ব্যবহার।

নিচে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্যসমূহ তুলে ধরা হল-
সাবেক প্রধানমন্ত্রী : বর্তমান সরকারের আমলে ভিক্ষুকের হাতেও শোভা পাচ্ছে মুঠোফোন। এটাই প্রমান করে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। আর এই সাফল্য এসেছে একক ভাবে আমাদের চেষ্টায়। এই সরকার আবার ক্ষমতায় এলে ইনশাল্লাহ মানুষের দুই হাতে দুটি মোবাইল শোভা পাবে। বিরোধী দল আমাদের এই উন্নয়নে বাধা দিলে এর সমুচিত জবাব দেয়া হবে।

সাবেক বিরোধী নেত্রী : বর্তমান সরকারকে রক্ত চোষা ভ্যাম্পায়ারের সাথে তুলনা করা চলে। ভিক্ষুকরাও এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দেশের মানুষ খেতে পাচ্ছে না আর সরকার মোবাইল ফোন নিয়ে বিলাসিতা করছে। আসুন আমরা সরকারের এই চক্রন্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই। আর সবাই মিলে শ্লোগান তুলি-
ভাত নাই পেটে-
মুঠোফোন ফোন আছে হাতে।

সাবেক মহাসচিব : দেশের আনাচে কানাচে আমরা যে ভাবে মুঠোফোন পৌছাই দিছি তা কল্পনারও অতীত। এখন বিরোধী দল দাবি করছে এই কৃতিত্ব তাদের একার। তারা ভাল কইরাই জানে তাদের এই দাবির কোন ভিত্তি নাই। এটাতো হইল গিয়া এই এরকম যে, বিচার মানিলাম কিন্তু তাল গাছটা আমার।

সাবেক বিরোধী দলীয় মহাসচিব : দেশে মুঠোফোনের ব্যবহার যে ভাবে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে করে দেশের যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। তারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করছে। বাপের পকেটের টাকা চুরি করে ফোনের বিল দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যত ধ্বংসের মুখে পড়বে। আমি বর্তমান সরকারের প্রতি আনুরোধ করব আপনারা অচিরেই এই ধ্বংসের খেলা বন্ধ করেন, নচেত হরতাল ডেকে দেশ অচল করে দেয়া হবে। দেশের জনগণ আমাদের সাথে আছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : দেশ চালাবার কাজে মুঠোফোন খুব ইম্পর্টেন্ট ভূমিকা রাখছে। প্রিভিয়াস সরকারের আমলে যোগাযোগের জন্যে আমাদের মান্ধাতা আমলের টি এন্ড টি ফোনের উপর ডিপেন্ড করতে হত। কিন্তু আমাদের সরকারের আমলে আমরা আধুনিক সিস্টেম মোবাইল ফোনের প্রচলন করেছি । এতে করে আমাদের ফোর্সরা অল টাইম আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছে। লেট সি, দেখি মুঠোফোনকে আর কি কি কাজে ইউটিলাইজড করা যায়।

সাবেক আইনমন্ত্রী : আমি এটাকে মুঠোফোন বলব না। কারণ আগে আমাদের দেখতে হবে এটাকে মুঠোফোন বলা যায় কিনা। এ ব্যপারে সংবিধানে কি বলা আছে। সংবিধান বর্হিভূত কোন কিছু তো আমরা করতে পারি না। কারণ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমি তো বুঝতে পারছি না বিরোধী দলের সমস্যাটা কোথায়।

সাবেক ধর্মমন্ত্রী : এটা হচ্ছে খৃস্টান ইহুদীদের তৈরী একটা জিনিস। প্রত্যেক মুমিন বান্দার প্রয়োজন এটাকে বর্জন করা। প্রাক ইসলামিক যুগে কোন টেলিফোন ছিল না, তারপরও মানুষের খবর আদান প্রদানে কোন সমস্যা হয়নি। সময় একটু বেশী লাগত এই যা। মাফ করবেন, আমার এই মাত্র একটি কল এসেছে, সম্ভবত ম্যাডামের। আমি কথা বলে আসছি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী : বাংলাদেশ অর্থনীতিতে দিনকে দিন আগাই যাচ্ছে। সেই দিন আর বেশী দূর নাই যেই দিন দেশের প্রত্যেইক নাগরিকের হাতে হাতে শোভা পাইবে মুটোফোন। এর থেইকা হামরা যে টেক্স পাইব তা দারাই দেশের অর্থনীতির চাক্কা বনবন কইরা ঘুরতে শুরু কইরা দিবে।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী : দেশের লোকজন মার্কেটগুলিতে যে ভাবে লাইন দিয়ে মোবাইল ফোন কিনছে যা ইউরোপ আমেরিকার মার্কেটগুলিতেও দেখা যায় না। আল্লাহর অশেষ রহমতে আর আমাদের দলের দোয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে।

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী : বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটির উপরে। আগামী এক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা গিয়ে দাড়াবে দশ কোটির উপরে। পরের বছর গিয়ে এই সংখ্যা দাড়াবে বিশ কোটি। তার পরের বছর-------

সাবেক বিদ্যুতমন্ত্রী : বর্তমানে মোবাইল ফোন আমাদের দেশের এক নম্বর সমস্যা। কারণ যেভাবে আমাদের দেশে ফোনের সংখ্যা বাড়ছে এতে করে এই ফোনগুলি চার্জ করতে দেশে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুত ঘাতটি দেখা দিচ্ছে। এটাই এখন লোডশেডিং এর অন্যতম প্রধান কারণ। আমি অনেক কষ্ট করে এই মূল্যবান তথ্যটি আবিস্কার করেছি।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মোবাইল কোম্পানীগুলি যে ভাবে ফ্রি কলের অফার দিচ্ছে এতে করে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলছে যা তাদের মস্তিষ্কের সেল গুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশে পাগলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার পরিবর্তে মোবাইল কার্ড কিনছে । ফলে দেশের লোকজন অপুষ্টিতে ভূগছে।

অবশেষে মুঠোফোনের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর তর্ক বিতর্কের পর কোন ধরনের মিমাংসা ছাড়াই গোল টেবিল বৈঠকের সমাপ্তি ঘটে। বর্তমানে সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল কাজ হচ্ছে সরকার এবং বিরোধী দলকে এক সাথে বসতে রাজী করানো এবং কোন একটি ব্যাপারে একমত হওয়া।

পরাধীনতা

মরুভূমির তপ্ত বালিতে এক ইরাকি মহিলা শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন ঠিক না, শুতে বাধ্য হয়েছেন। মর্টারের গোলার আঘাতে তিনি মারাত্নক ভাবে আহত হয়েছেন। অনবরত রক্তরণ হচ্ছে। রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মরুভূমির বালি তা শুষে নিচ্ছে। তিনি জানেন মৃত্যু আসছে খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে। নিজের জন্যে তার খারাপ লাগছে না, তার পরিবারের সবাই বোমার আঘাতে মারা গেছে, একা তিনি কার জন্যে বেঁচে থাকবেন। খারাপ লাগছে তার অনাগত শিশুর জন্যে, যে আর কয়েকদিন পরই এই পৃথিবীতে আসত।
মা, মা ডাকে তিনি চমকে উঠেন, কে ডাকছে?
মা আমি, তার ভ্র“ণ তার সঙ্গে কথা বলছে!
একি তার অবচেতন মনের কল্পনা, নাকি বাস্তবেই এটা ঘটছে? তিনি তার সন্তানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন।
মা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ?
হ্যাঁ, ছোট্র সোনা, আমি শুনতে পারছি।
মা, তুমি কি মারা যাচ্ছ?
আমি জানি না সোনা।
তুমি মারা গেলে কি আমিও মারা যাব মা ? এই পৃথিবী দেখতে পারব না।
ছোট্র সোনা আমার, তুমি এই ভয়ানক পৃথিবীতে এসে কি করবে? চারদিকে এত যুদ্ধ!
যুদ্ধ কেন হচ্ছে মা ?
এক মুহুর্তের জন্যে তিনি থমকে যান। আসলে কেন হচ্ছে এই যুদ্ধ? কিসের জন্যে? এক ফোঁটা তেলের জন্যে কয় ফোঁটা রক্ত ঝরছে, কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে!
সারা শরীর তার অবসাদে ভেঙে আসছে।
ছোট্র মানিক আমার, তুমি শান্তিতে ঘুমাও, আমি ঘুম পাড়ানি গান গাই। কিন্ত কোন ঘুম পাড়ানি গানই তার মনে আসছে না।
এ মুহুর্তে বুশ নিশ্চয় তার ফার্ম হাইজে অবকাশ যাপন করছেন। মার্কিন-ব্রিটিশ শিশুরা হয়ত কম্পিউটারে যুদ্ধের গেইম খেলতে ব্যস্ত। অথচ তাদের মতো সাধারণ লোকের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে কঠিন বাস্তবতা। এক সময় হয়ত এ যুদ্ধ থেমে যাবে, কিন্তু তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ কি কখনও শেষ হবে ? সে যুদ্ধ ক্ষুধার যুদ্ধ, দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ!
মা, মা আমি তোমাকে দেখতে চাই মা !
তার বাচ্চা এ পৃথিবীতে আসার জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি ফিসফিস করে বাচ্চাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনানোর চেষ্টা করছেন। তার বাচ্চার এ ঘুম আর কখনও ভাঙবে না।
মরূভূমিতে দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসে। এক সময় রাতের আঁধার কেটে গিয়ে দিনের আলো ফুটবে, কিন্তু সেই আলো তিনি দেখতে পাবেন না। তার বাচ্চা দেখতে পাবে না। কিছু রাত আছে যার কোন ভোর নেই।

(বেশ কিছুদিন আগে ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ চলাকালীন সময় পত্রিকায় আমি এক ইরাকী আত্নঘাতী হামলাকারীর খবর পড়ি, সেই হামলাকারী ছিলেন একজন মহিলা এবং তিনি ছিলন গর্ভবতী। ব্যপারটা বুঝতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। যুদ্ধ একটা মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়!
বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা একটা অস্থির সময় কাটাচ্ছি, তারপর ইশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার জন্ম ইরাকের মত কোন পরাধীন রাষ্ট্রে না হয়ে একটি স্বাধীন দেশে হয়েছে।
সপ্ম্প্রতি আমেরিকায় পোষা প্রাণীদের বিনোদনের জন্যে কিছু ক্লাব খোলা হচ্ছে। উত্তম প্রস্তাব। আমি খুব আশাবাদী, কারণটা ব্যাখা করছি-
ছোট বেলায় কবি জীবনান্দ দাশের একটি কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম-
আমি আবার আসিব ফিরে, এই ধাঁনসিড়িটির তীরে
হয়ত শালিক, নয়ত কোন শঙ্খচিলের বেশে।
পরজন্মে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব আমাকে যদি আবার পৃথিবীতে পাঠানো হয় তবে যেন আমার জন্ম ইরাকের মাটিতে না হয়। আমেরিকার মাটিতে, অন্তত মানুষ না হলেও কুত্তা (কুকুর সমাজ মা করবেন) হিসেবে।
আমি আবার আসিব ফিরে, এই পৃথিবীতে
হয়ত মানুষ, নয়ত কোন আমেরিকান কুত্তার বেশে।

প্রবাস

আমি আগেই জানতাম এ রকম একটা কিছু হবেই, কিন্তু তোর বাবা তো শুনল না, আমেরিকান ছেলে দেখে মজে গেল। ছোটলোকের বাচ্চা- এনগেজমেন্ট এর দিন কেউ এভাবে বিয়ে ভেঙে দেয়। আরে বান্দর, তোর গলায় কি আর মুক্তার মালা মানাবে।-মিলির খালা এক নিশ্বাসে কথা কটি বলে দম নেন।
মিলি মনে মনে তিন বার উচ্চারণ করে, মুটকি- মুটকি- মুটকি-এটা মিলির রাগ কমনোর নিজস্ব পদ্ধতি। মিলির বিয়ের ব্যাপারে এই খালার উৎসাহই ছিল সবচেয়ে বেশী।
নতুন ম্যাজেশিয়ানের পকেটে যেমন সব সময় এক প্যাকেট তাস থাকে, তেমনি মিলির এই মুটকি খালার হাত ব্যাগে সবসময় থাকবে এক গাদা পাত্র-পাত্রীর ছবি। সুযোগ পেলেই এই মহিলা উনার তাসের খেলা দেখাতে শুরু করে দেন। প্রথমে ব্যাগ খেকে বের হবে জোকার-অর্থাৎ সাধারণ মানের পাত্র-পাত্রীর ছবি, তারপর রাজা-রানী এবং সবশেষে টেক্কা। আগের ছবিগুলি দেখে কেউ যদি হাল ছেড়ে দেয়া শুরু করে তখন খালা টেক্কাগুলি ফেলে বিজয়ীর বেশে দর্শকের দিকে তাকাবেন। এরা উনার দৃষ্টিতে সেরা মানের পাত্র-পাত্রী। এ রকমই এক টেক্কা (আমেরিকা প্রবাসী ছেলে)-র সাথে তিনি মিলির বিয়ে ঠিক করেছিলেন।
লজ্জায় মিলি চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
আজ সকালে ছেলের মা ফোন করেছিলেন-ছেলে তিন মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল, ইচ্ছে ছিল এর মধ্যে মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে পরবর্তীতে এসে বউ নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ কি এক জরুরী কাজে তাকে আমেরিকা ফিরে যেতে হচ্ছে। মিলির খালার ধারণা এটা তাদের ছেলেকে বিয়ে না করানোর একটা অজুহাত। মিলির খালার বোধ হয় আরও কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিলির মা এর কারণে বলতে পারেন না। মিলির ধারণা তার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা দের একজন। নিজের সন্তানের যে কোন বিপদে তিনি সবসময় তাদের আগলিয়ে রেখেছেন। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু তিনি মিলিকে কিছু বুঝতে দিচ্ছেন না। যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। ধীরে ধীরে এক সময় মিলি সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করে।
এর কিছুদিন পরে আমেরিকা থেকে মিলির নামে একটা চিঠি আসে-

মিলি,
প্রথমেই তোমাকে তুমি করে বলার জন্যে মা চাচ্ছি। তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট হবে তাই তুমি করেই বলছি। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আমি হাত জোর করে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। বিয়ে ভেঙে দেয়াটা ছিল আমার একক সিদ্ধান্ত, আমার পরিবারের কোন ভূমিকা এখানে ছিল না। এর কারণটা বলার জন্যেই তোমাকে চিঠি লেখা, ব্যাখাটা তোমার কাছে গহণযোগ্য মনে হবে কিনা আমি জানি না। তারপরও বলছি-
আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রবাসে। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হীন এক নিঃসঙ্গ জীবন। দেশ থেকে চিঠি আসলে বেশির ভাগই আমি পড়তাম না, কারণ সেগুলিতে টাকা পাঠানোর তাগিদ ছাড়া আর
কিছুই থাকত না। কারো পরীক্ষার ফি, কারো ব্যাবসার জন্যে টাকা, কারো বা চিকিৎসার খরচ। আমি যেন টাকা পাঠানোর একটা মেশিন ছাড়া আর কিছু না। মনে পড়ে প্রথম যেদিন দেশে ফোন করি বাবা ফোন ধরেন। এত দিন পর দেশ থেকে পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নিজের অজাত্তেই আমার চোখ ভিজে আসে। বাবা প্রখম যে কথাটি বলেন তা হচ্ছে তুই টাকা পাঠাতে এত দেরী করছিস কেন? আমারতো এখানে প্রচুর দেনা, এত টাকা খরচ করে তোকে বিদেশে পাঠালাম। ফলে দেশে আসার আগ্রহ আমি কখনই অনুভব করিনি।
দীর্ঘ এক যুগ পর আমি দেশে আসি। তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখি সেদিন আমি একটা ধাক্কার মত খাই। আমার তখন মনে হয়েছিল পুথিবীর সবচেয়ে রুপসী তরুণীটি আমার সামনে বসে আছে। কেন যেন তখন আমার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। নিজেকে তখন বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট এর সেই দৈত্যের মত মনে হচ্ছিল। তখন মনে হল ইচ্ছে করলেই আসলে সব কিছু আবার আগের মত নতুন করে শুরু করা যায় না। সময় সব কিছু বদলে দেয়। আমি ইচ্ছে করলেই এখন পুথিবীর সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের গাড়ীটি কিনে ফেলতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই নিজের বয়সের চেয়ে অর্ধেক বয়সের তরুণীর হাত ধরে ভালবাসার কথা বলা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সময়টুকু আমি অনেক আগেই পার করে এসেছি।
যাক্ চিঠি আর দীর্ঘ করছি না। হঠাৎ করে আজ কেন যেন তোমাকে লিখতে ইচ্ছে হল তাই এই চিঠি লেখা। নিজের সমস্যার কথা আসলে অন্যকে বলতে ভাল লাগে না।
মিলি বেঁচেঁ থাকাটা বোধ হয় খুব একটা খারাপ না, যদি নিজের মত করে বেঁচে থাকা যায়। এই যে আমার একাকী জীবন এটাকে এখন আর খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। কি দরকার নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়ে। এভাবেই হয়ত ভাল আছি।
প্রার্থনা করি খুব চমৎকার হৃদয়বান একটি ছেলের সাথে যেন তোমার বিয়ে হয়। যার হাত ধরে র্নিভাবনায় বাকী জীবনটা তুমি কাটিয়ে দিতে পার-
চিঠি এখানেই শেষ। নাম ঠিকানা কিছুই নেই।
আশ্চর্য এ মুহুর্তে মিলি কিছুতেই লোকটার নাম মনে করতে পারছে না, কিন্তু কেন যেন জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

(আমাদের দেশের কোন এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার বন্ধ করে দেয়া উচিত, যেহেতু তারা দেশে না থেকে বিদেশে থাকে। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের দেশের অর্থনীতি দেশে পাঠানো প্রবাসীদের টাকার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শখ করে কেউ বিদেশে থাকতে চায় না, পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে। আমাদের ধারণা বিদেশে আমাদের দেশের লোকজনেরা সম্ভবত রাজার হালে আছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার কামাচ্ছে। কিন্তু দেশের জন্যে যখন তাদের মন আকুলি -বাকুলি করে তখন তাদের সেই কান্না আমরা দেখতে পাই না।

কবি জীবনান্দ দাসের সেই কবিতার লাইনটি আমার মাঝে মধ্যে মনে পড়ে-
হায় চিল সোনালী ডানার চিল
প্র্বাসীদের আমার কাছে সেই চিলের মতো মনে হয়, যার ডানা দুটি ভাঙ্গা। সীমাহীন আকাশ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সেই আকাশে ডানা মেলতে পারছে না।)