জামিল আহমেদ রুনুকে বসতে নির্দেশ করেন।
আপনি এখন যা দেখবেন তা কেবলই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। বাস্তবের সাথে একে কম্পেয়ার করার কিছু নেই। আমি কি শুরু করব?
হ্যাঁ। রুনু সহজ ভাবে উত্তর দেয়।
আপনি এখানে বসুন প্লীজ।
অদ্ভুত দর্শন একটি চেয়ারে রুনু বসে পড়ে। জামিল আহমেদ এবার রুনুর হাতের বিভিন্ন অংশে অনেকগুলি সেন্সর লাগানো তার টেপ দিয়ে আটকে দেন। মাথায় হেলমেটের মতো দেখতে একটি জিনিস পড়িয়ে দেন। এতে রুনুর চোখ ঢাকা পড়ে যায়। এখন আর সে কিছু দেখতে পারছে না। কানের দুই পাশে লাগানো ইয়ার ফোনে জামিল আহমেদের ধাতব কন্ঠস্বর ভেসে আসে-আমরা শুরু করছি।
রুনুর কানের পাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। চোখের সামনে আবছা আবছা আলোতে বিচিত্র বর্ণের খেলা। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা মনে হচ্ছে চারপাশের জগতকে। কুয়াশা ভাব ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করে। আবছা আবছা কিছু লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। এবার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কয়েক জনকে সে চিনতেও পারছে। তার আত্নীয় স্বজন। এরা সবাই তার বাড়ীতে কি করছে। ঘটনাটা যেন আগেও একবার ঘটেছে। মনে পড়ছে না।
দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। অনেক লোক একটি টেবিলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের মাঝখানে একটি কেক, কয়েকটি মোমবাতি জ্বলছে। সম্ভবত কারো জন্মদিন, কিন্তু কার?
সামনের দৃশ্য আবার বদলে যেতে শুরু করে। একটি ছোট ছেলে কেক কাটছে। পাশে তার মা দাঁড়ানো। ছোট ছেলেটি কাব্য, তার মা রুনু নিজেই। কাব্য একটি কেকের টুকরো তার মাকে খাওয়াচ্ছে। রুনু নিচু হয়ে তার মুখ ছেলের মুখের সামনে নিয়ে আসে। রুনুর মনে হচ্ছে তার শরীরের ভিতর দিয়ে হাজার ভোল্টের বিদ্যুত প্রবাহিত হচ্ছে। তার মুখে কাব্যের নিঃশ্বাস এসে পড়ছে। রুনু ছেলেকে চুমু খেল। তার প্রতিটি স্নায়ুতে কাব্যের স্পর্শ ছড়িযে পড়ছে। কাব্য দৌড়ে দু’তলা যাবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে, পেছনে তার মা। হঠাৎ পিছলে কাব্য পড়ে যায়। তার হাঁটু ছড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাঁথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেছে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটা হাত রুনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আম্মু আম্মু করে ডাকছে।
রুনু ছুটে যেতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। চোখের পানিতে তার দু’গাল ভিজে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই রুনু চিৎকার করে উঠে। চিৎকার করার সাথে সাথে আবার সব কিছু আগের মত হযে যায়। রুনু টের পায় মাথার উপর হেলমেটের মতো চেপে বসা যন্ত্রটি সরে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ লাগে রুনু বুঝে উঠতে সে কোথায় আছে। হার্ট বিট বেড়ে যাওয়াতে রুনু হাপাচ্ছে। চট করে গাল স্পর্শ করে দেখে তার দু’গালই ভেজা। সত্যিই সে কাঁদছিল। জামিল আহদমদ এগিয়ে এসে তার হাতের তারগুলি খুলে দেন।
তা আজকে কেমন লাগল আমাদের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এই জগত?
কথা বলতে রুনুকে প্রচন্ড মানসিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
আমার কাব্য ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে, তার সাহায্য দরকার।
রুনু, আমি আগেও বলেছি কাব্য বলে বাস্তবে কেউ নেই। সে শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এখানে প্রোগ্রামার যেভাবে প্রোগ্রামটি তৈরী করবেন আপনি সেভাবেই দেখতে পাবেন।
রুনু হাপাতে হাপাতে বলে পুরো ব্যাপারটি শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম হতে পারে না। আমার ছেলের স্পর্শ এখনও আমার গালে লেগে রয়েছে। আপনি আমাকে আমার ছেলের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
দেখুন রুনু, আমাদের তৈরী এই ভার্চূয়াল জগত আমাদের ব্যাবসারই একটি অংশ। এর মাধ্যমে আমরা মানুষকে বিনোদন দিয়ে থাকি। বিনিময়ে আমার টাকা পাই। কাউকে কষ্ট দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
আমার ছেলে কাব্য রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে আজ ছয়টা মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও আমি রাতে ঠিক মতো ঘুমুতে পারি না। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠি। মনে হয় আমার ছেলে দরজার বাইরে থেকে আমাকে ডাকছে। পরম মমতায় দরজা খুলে দেখি কোথাও কেউ নেই। এরপর সারা রাত আর ঘুমুতে পারি না। খালি মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েল আমার ছেলে এসে আমাকে না পেয়ে ফিরে চলে যাবে। তারপর একদিন আপনাদের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে চলে আসি। আপনারা যে ছেলেটিকে তৈরী করেছেন সে অবিকল আমার কাব্যের মতো। তার ভালোবাসার টানে আমি আজ এক সপ্তাহ ধরে রোজ এখানে ছুটে আসি। এই ছেলেটিকে আমি কাব্যের মতোই ভালোবাসতে শুরু করেছি। মনে হচ্ছে আমার কাব্যই আবার ফিরে এসেছে।
জামিল আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঠিক আছে এবার আমি আপনাকে প্রোগ্রামের বাকী অংশটুকু দেখাচ্ছি। তবে আপনি তা না দেখলেই ভাল করতেন।
রুনু আবার গিয়ে আগের চেয়ারটিতে বসে পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই রুনু পৌছে যায় ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে। আগে যেখানে শেষ হয়েছিল এবার তার পর থেকে শুরু হয়। রুনু কাব্যকে মেঝে থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। রুনু কাঁদছে। ছেলের মুখে হাসি।
এবার দৃশ্যপট সম্পূর্ন বদলে যেতে আরম্ভ করে।
রাতের সময় একটি গাড়ী রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। গাড়ী চালাচ্ছে কাব্যের বাবা জয়। রুনু পিছনের সিটে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। কাব্য ঘুমিয়ে পড়েছে। রুনুর চোখেও ঘুম। জয় ঘন ঘন হাই তুলছে। হঠাৎ কয়েক মুহুর্তের জন্য ঝিমুনি এসে পড়ে। এই কয়েক সেকেন্ডেই গাড়ী রাস্তা থেকে পাশের মাঠে ঢুকে পড়ে। জয় স্টিয়ারিং এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ী নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই পাশের এক গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। তারপর শুধু কাঁচ ভাঙার শব্দ।
আবার দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে।
রুনুর জ্ঞান ফিরে আসছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। মাথাটা মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ে যাবে। সামনে জয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সামনে ড্যাশবোর্ডে তার মাথা ঠুকে আছে। কাব্যের শরীরের নিচের অংশটা এখনও রুনুর হাতে ধরা রয়েছে। কিন্তু উপরের অংশটুকু গাড়ীর জানালার কাচ ভেঙে বাইরে বের হয়ে রয়েছে। মাথাটা থেতলে গেছে। রুনুর গলা দিয়ে জবাই করা পশুর চিৎকার বেরিয়ে আসে। হঠাৎ করে রুনু বাস্তবতায় ফিরে আসে । সামনে জামিল আহমেদের ভীত মুখ আবিস্কার করে। তার মানে আসলেই সে এতক্ষণ চিৎকার করছিল। রুনু উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। সে রীতিমতো টলছে। ধপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ে।
জামিল আহমেদ এগিয়ে আসেন। আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন। রুনু মাথা নাড়ে। কোন মতে উচ্চারণ করে আমার ছেলে আবার মারা গেছে।
জামিল আহমেদ এক গ্লাস পানি রুনুর দিকে এগিযে দিয়ে বলেন- আপনার কাব্যের মৃত্যূ একবারই হয়েছে। এখন যে মারা গেছে সে আপনার ছেলে নয় । শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। আমি এজন্যেই আপনাকে এ অংশটুকু দেখাতে চাচ্ছিলাম না।
আমি কি আবার আমার ছেলেকে দেখতে পারি।
জামিল আহমেদ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে রুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। না আপনি আর এই জগতে ঢুকতে পারবেন না। আমার প্রোগ্রামটি নষ্ট করে ফেলেছি। আপনার জন্য আমাদের তৈরী করা প্রোগ্রামের এটাই ছিল শেষ অংশ। আমাদের প্রোগ্রাম এখানেই শেষ।
রুনু কিছুক্ষণ জামিল আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
জামিল সাহেব আপনি এক সন্তান হারা মাকে তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছেন। হোক তা ক্ষণিকের কাল্পনিক ভালোবাসা। আপনাকে ধন্যবাদ। এই টুকু বলে রুনু চলে আসে।
জামিল আহমেদের মনটা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। একজন মার সাথে তিনি প্রতারণা করেছেন। প্রোগ্রামটা আসলে নষ্ট করা হয়নি। সম্পূর্ন অক্ষত আছে। এটা করা ছাড়া আসলে উনার কোন উপায় ছিল না। রুনু কাল্পনিক জগতের কাব্য নামক এক চরিত্রকে ভালোবাসতে শুরু করে ছিল। কাল্পনিক এই কাব্যকে বাস্তব জগতের তার ছেলে কাব্যের সাথে মেলাতে চেষ্টা ক
রছিল। এ এক অপার্থিব ভালোবাসা। এত করে শুধু তার কষ্টটুকুই বাড়ত। তারচেয়ে বরং এটাই ভাল হয়েছে। পার্থিব এই জগতে অপার্থিব ভালোবাসার কোন স্থান নেই।
Friday, February 13, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment