Sunday, February 22, 2009

ভাষা সৈনিক ও আমাদের এই প্রজন্ম


আলম সাহেব উনার কর্মজীবন থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। প্রতিদিন সকাল বেলা তিনি পার্কে হাঁটতে বের হন। সারাজীবন কাজের মধ্যে থেকেছেন। কর্মহীন জীবন তিনি মোটেও উপভোগ করতে পারছেন না। খালি মনে হয় এই বুঝি বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। ছোট ছোট কিছু বাচ্চা ছেলে প্রতিদিন পার্কে কাগজ কুড়াতে আসে। পার্কের বেঞ্চে বসে তিনি তাদের কাজ দেখে অনেকটা সময় কাটান। এক সময় নিজের অজান্তেই এদের সাথে উনার সখ্য গড়ে উঠে। ঠিক করেন এদের তিনি পড়তে শেখাবেন। প্রথম প্রথম এরা এটাকে নতুন একটি খেলা ভেবে মজা পায়। তারপর খেলাচ্ছলেই একসময় তারা শিখতে শুরু করে। আলম সাহেব জানেন তিনি এদের বেশী দূর নিয়ে যেতে পারবেন না। সেই সার্মথ্য উনার নেই। তারপরও তিনি চান অন্তত বাংলা ভাষায় এদের হাতেখড়ি টুকু হোক।

শহীদ মিনার চত্বরটা যেন বহু দিন পর আবার প্রাণ ফিরে পেল। চারদিক ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করা হয়েছে। আর করা হবে না কেন। আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারী। অনেক গণ্য মান্য লোকজন, নেতা, নেত্রীরা আসবেন এখানে পুস্প অর্পণ করতে। সারা বছর এখানে জমে থাকে ফেরীওয়ালা, ছিনতাইকারী আর মাদক সেবীদের আড্ডা। তবে আজকের কথা ভিন্ন। কাল থেকে আবার শহীদ চত্বর তার পূর্বের রূপে ফিরে যাবে।

আলম সাহেব উনার শিষ্যদের নিয়ে শহীদ মিনারে আসেন। কিন্তু ভিতরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সিকিউরিটি গার্ড পথেই উনাকে আটকে দেয়। একটু পর প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী আসবেন এখানে ফুল দিতে। অতএব এখন সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষেধ।

ভোর হতেই শুরু হয় হুড়াহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি। কে কার আগে খালি পায়ে ফুল দেবে তারই যেন প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। যে রাজনৈতিক দল সবার আগে এখানে এসে ফুল দিতে পারবে বুঝতে হবে এরাই হচ্ছে আসল ভাষা প্রেমিক। বাংলা ভাষা নিয়ে আজ এরা যে বক্তৃতা দেবেন তা শুনলে যে কারো চোখ ভিজে আসবে। এদের ছেলে মেয়েদের অবশ্য এরা পড়াবেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কারণ প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে হলে জানতে হবে ইংরেজী। বাংলা শিখে কি লাভ! এখনকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলির নিয়ম আবার বেশ কড়া। স্কুলে ভুলেও ইংরেজী ছাড়া বাংলায় কথা বলা যাবে না।

আলম সাহেব ফুল না দিয়ে ফিরে চলে আসেন। উনার মনে হয় শুধু বছরের একটি দিনে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা সৈনিকদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে এ দিনটিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে আমরা তাদের প্রতি খুব দায় সারা ভাবে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। অথচ আমরা কত সৌভাগ্যবান জাতি যাদের রাষ্ট্রে এমন একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের আর কোন দেশে কেউ তাদের মায়ের ভাষার জন্য প্রান দিয়েছে বলে উনার জানা নাই।

ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও আমাদের দেশে শিক্ষার হারের খুব একটা অগ্রগতি নেই। শুদ্ধ করে এখনও অনেকে বাংলা বলতে লিখতে জানে না। সাইনবোর্ডগুলিতে ভুল বাংলার ছড়াছড়ি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজী শিক্ষার চর্চা চলছে। আজকের সমাজে অনেকে শুদ্ধ ইংরেজী বলতে না পারলে লজ্জিত হন। অথচ শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারার জন্য কাউকে তিনি লজ্জিত হতে দেখেননি। এখনকার প্রজন্ম হচ্ছে ডি অর্থাৎ জিজুস নামক নতুন এক প্রজন্ম। এরা বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে নতুন এক ভাষায় কথা বলে। এখনকার বাচ্চারা ঠাকুরমার ঝুলি শুনতে পচ্ছন্দ করে না। তাদের প্রিয় চরিত্র হ্যারি পটার। এক সময় ছাত্ররা তাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। আজও ছাত্ররা প্রাণ দিচ্ছে তবে ভাষার জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের লড়াইয়ে। একুশে বই মেলায় বিদেশী ভাষার লেখকের বইয়ের ছড়াছড়ি। বাড়ীতে আমরা হিন্দি সিরিয়াল দেখি আর নাটকের চরিত্রগুলির দুঃখ দেখে চোখের জল ফেলি।

বিদেশী ভাষা শিখা নিয়ে উনার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যখন নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বিদেশী সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে শুরু করি তখন তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। এ যেন নিজের মাকে বাদ দিয়ে বিমাতার প্রতি ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগে নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে জানুক বুঝুক। তারপর বিদেশী ভাষা সংস্কুতির শিক্ষা লাভ করুক। ভাষা সৈনিকরা আমাদের কাছে ফুল চান না। তারা চান যে ভাষার জন্য তারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন দেশের প্রতিটি মানুষ সেই ভাষায় মিক্ষা লাভ করুক। আমরা যদি দেশের একটি নিরক্ষর লোককেও অক্ষর শিক্ষা দিতে পারি তবে ভাষা সৈনিকদের প্রতি কিছুটা হলেও আমরা আমাদের ঋণ শোধ করতে পারব।

যেদিন দেশে একটিও নিরক্ষর লোক থাকবে না, সবাই শুদ্ধ ভাবে বাংলা ভাষা লিখতে, পড়তে, বলতে জানব সেদিন অন্তত আমরা বলতে পারব- হে, ভাষা সৈনিক আমাদের এ প্রজন্ম কিছুটা হলেও তোমাদের ঋণ শোধ করতে পেরেছে।








Saturday, February 21, 2009

ঈশপের গল্প ও একটি মোবাইলের বিজ্ঞাপনের গল্প


ঈশপের গল্পের প্রথম অংশ:
এক দেশে ছিল এক রাখাল বালক। সে মাঠে ভেড়া চরাতে গেলে প্রায়ই মজা করার জন্য বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করত। তার ডাক শুনে লোকজন তাকে বাঁচাতে ছুটে আসলে সে মজা পেয়ে হাসত।

ঈশপের গল্পের দ্বিতীয় অংশ:
একদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসল। কিন্তু তার চিৎকারে কেউ সাড়া দিল না। সবাই ভাবল সে আজো বুঝি মজাই করছে। ফলে রাখাল গেল বাঘের পেটে।

ঈশপের উপদেশ: কখনও মিথ্যা বলে লোকজনকে বোকা বানাবে না। এমনকি মজা করার জন্যও নয়।

আধুনিক ঈশপের গল্পের প্রথম অংশ:
এক দেশে ছিল এক মোবাইল কোম্পানী। এরা প্রায়ই মজা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন বানিয়ে লোকজনকে বোকা বানাত। এক বার তারা পত্রিকায় এক মডেলের নিখোঁজ সংবাদ প্রচার করল। পত্রিকা অফিসে উদ্বিগ্ন অগণিত ভক্তকূলের ফোন আসতে শুরু করল। এর কয়েক দিন পর ঐ মডেলকে পাওয়া গেল। তিনি আসলে নিখোঁজ হননি। মোবাইল কোম্পানী মজা করার জন্য এই নাটক সাজিয়েছে। এটা তাদের নতুন ধরনের এক বিজ্ঞাপন।

আধুনিক ঈশপের গল্পের দ্বিতীয় অংশ:
এক দিন সত্যি সত্যি এক মডেল নিখোঁজ হল। কিন্তু এবার আর কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই ভাবল এটাও মোবাইল কোম্পানীরই কোন নতুন ধরনের বিজ্ঞাপনেরই কৌশল হবে। ফলে এক সময় ঐ মডেল নিখোঁজ হয়ে চিরতরে হারিয়ে গেল।

আধুনিক ঈশপের উপদেশ: কখনও মিথ্যা বলে লোকজনকে বোকা বানাবে না। এমনকি মজা করার জন্যও নয়।


(এদেশের মিডিয়া বর্তমানে মোবাইল কোম্পানীগুলির পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। আর পয়সা দিলে মডেলদের দিয়ে যে কোন ধরনের কাজ করানো সম্ভব।
বাংলালিংক মোবাইল কোম্পানী কিছুদিন পূর্বে যে কান্ড করল তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। অচিরেই দেশে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইন করা জরুরী। আর এদের পক্ষ নিয়ে অভিনেত্রী জয়া আহসান নির্লজ্জ সাফাই গাইলেন। নতুন ধরনের কোন কিছুকে নাকি আমরা বাঙালীরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে অভ্যস্থ নই।

জয়া আহসান আপনার পরিবারের কোন সদ্যস্যের যদি সত্যি সত্যি এমন ধরনের বিপদ হয় তাহলে আপনার কেমন লাগবে। তখনওকি আপনি সাফাই গেয়ে যাবেন। আপনার কি কোন ধারণা রয়েছে একটা পরিবারের কোন সদস্য হারিয়ে গেলে ঐ পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন এদের কেমন লাগে?
আর আপনি আপনার ভক্তদের ভালোবাসা নিয়ে যে প্রতারণা করলেন তাতে করে তাদের কাছে কি আপনার ইমেজ বাড়ল না কমল?

আর দেশের মোবাইল কোম্পানীগুলি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এরা প্রতিনিয়তই এদের গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে বোকা বানিয়ে চলেছে। একটা একটা করে এদের বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর অফারের বর্ণনা দিতে গেলে পুরো মহাভারত তৈরী হয়ে যাবে। অতএব অচিরেই এ দাবনদের নিয়ন্ত্রণ কার হোক। না হলে ভবিষ্যতে অমাদেরকে অনেকগুলি ফ্রাঙ্কেস্টাইনের সম্মুখিন হতে হবে।)


Monday, February 16, 2009

প্ল্যানচেট


অপালাদের ফ্ল্যাটে মিসেস গোমেজ নামে এক খ্রিস্টান মহিলা থাকেন। তিনি দিনে দুপুরে মৃত আত্না ডেকে নিয়ে আসতে পারেন। কিছুদিন আগে নাকি তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এনেছিলেন। তবে জীবিত না, উনার আত্না। স্বর্গে রবি ঠাকুর খুব সুখেই আছেন। খাওয়া দাওয়ার কোন অভাব নেই। যা ইচ্ছে তা খাওয়া যায়। বাথরুম করার কোন ঝামেলা নেই। সারা জীবন কবিতা লিখে কাটিয়েছেন। এখন আর কবিতা ছাড়া ভালো লাগে না। স্বর্গের অপ্সরারা প্রতিদিন বিকেলে উনার কাছে কবিতা শুনতে আসে। রবি ঠাকুর মিসেস গোমেজের কাছে কবিতা লেখার কিছু কাগজ চেয়েছেন। কারণ উনাদের ঐখানে আবার এসব জিনিস পাওয়া যায় না। রবি ঠাকুর উনাকে একদিন এসে কবিতাও শুনিয়ে গেছেন-

মেযেটি যখন ধর্ষিত হচ্ছিল তখন সে ডেকেও ঈশ্বরকে কাছে পায় নি।
দারিদ্রতার কাছে পরাজিত হয়ে মা তার নবজাতককে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে ।
আমার জানতে খুব ইচ্ছে করে, ঈশ্বর আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
ঈম্বর মৃদু হেসে উত্তর করেন- এ কুৎসিত সমাজ ব্যবস্থা তোমাদেরই তৈরী আমার নয়।

প্রতিদিন মহিলার কাছে শুনে শুনে অপালা খুব আগ্রহী হয়ে উঠে। অনেক দিন মহিলার পেছনে ঘুরঘুর করার পর মহিলা শেষ পর্যন্ত রাজী হন। মিসেস গোমেজ তাকে ঠিক রাত বারটা সময় আসতে বলে দেন। আত্নারা আবার খুব পাংচুয়াল হয়ে থাকে। দিনে আত্নাদের বিরক্ত করা যাবে না। এ সময় তাদের বিশ্রামের সময়।

অপালা রাত বারটা বাজার আগেই এসে পড়ে। মিসেস গোমেজ তাকে নিয়ে ছোট্র একটি টেবিলে মুখোমুখি বসেন। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। টেবিলে শুধু একটি মোমবাতি জ্বলছে। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। স্বল্প আলো আঁধারের মাঝে গা ছমছমে এক পরিবেশ। মিসেস গোমেজের সামনে একটি বোর্ড। এর নাম উইজা বোর্ড। বোর্ডে ইংরেজী সব অক্ষর বসানো। মিসেস গোমেজের অপালাকে বুঝাতে থাকেন, এই যে ছোট্র ঘুটিটি দেখতে পারছ আমি এটার উপর একটি আঙ্গুল রেখে আত্নাকে ডাকতে শুরু করব। যদি আত্না আসে তবে ঘুটি বোর্ডের ইয়েস লেখা ঘরে চলে যাবে। আর না আসলে নো লেখা ঘরে। আমি প্রশ্ন করলে তিনি তার উত্তর দেবেন। মুখে তা দেবেন না। উইজা বোর্ডের মাধ্যমে দেবেন। ধর আমি যদি উনার নাম জানতে চাই আর উনার নাম যদি হয় জন তবে ঘুটি প্রথমে ইংরেজী জে অক্ষরে যাবে, তারপর ও, এইচ এবং শেষে এন লেখা অক্ষরের উপর। এভাবেই তুমি জানতে পারবে যে উনার নাম জন। অপালা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে।

আচ্ছা আন্টি, ভূত যদি ইংরেজী না বুঝে তবে কি বাংলায় উত্তর দেবে।
দেখ আমি রসিকতা মোটেই পছন্দ করি না। আর তুমি ভূত বলছ কেন। এরা হচ্ছে বিদেহী আত্না। কোন দূর্ঘটনায় পড়ে যাদের অকালে মৃত্যু হয় তাদের আত্না ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে যেতে পারে না। তাদের আত্না এই জগতেই ঘুরপাক খেতে থাকে।

মিসেস গোমেজ আজকে উনার স্বামীর আত্না ডেকে আনবেন। এক বছর আগে উনার স্বামী এক রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। মিসেস গোমেজ নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলতে থাকেন- হে দুষ্ট আত্না সকল দূর হয়ে যান।
আত্নাদের আপনি করে না বললে এরা নাকি খুব মাইন্ড করে। মৃত্যুর পর জগতে আছে দুই ধরনের আত্না। ভাল আর মন্দ। এদের মধ্যে প্রায়ই ঝঁগড়াঝাঁটি মারামারি চলতে থাকে। কিছুদিন আগেই এক আত্না এসে নাকি মিসেস গোমেজের কাছে নালিশ করে গেছে উনার স্বামী মিস্টার গোমেজ তার প্রেমিকাকে নিয়ে ভেগে গেছেন। যদি ভুল করে দুষ্ট আত্না নামিয়ে ফেলা হয় তবে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তখন আর তাকে সহজে বিদেয় করা যায় না।

মিসেস গোমেজ চোখ বন্ধ করে নাঁকি সুরে বলতে আরম্ভ করেন-হে আমার স্বামী, আপনি দয়া করে দেখা দিন.........
অপালার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। হঠাৎ মিসেস গোমেজ চিৎকার করে উঠেন-অপালা তিনি এসেছেন। তুমি উনার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাচ্ছ না।
অপালা ফিসফিস করে বলে-জ্বী, শুনতে পাচ্ছি। তবে নিঃশ্বাসের নয়, বিড়ালের মিঁউমিঁউ শব্দ। আমার মনে হয় আপনার স্বামী বিড়ালের রূপ ধরে এসে হাজির হয়েছেন।

মিসেস গোমেজ গম্ভীর স্বরে বলে উঠেন-এটা আমার পোষা বেড়ালের ডাক। টেবিলের নিচে বসে আছে। আর আত্নাদের নিয়ে ঠাট্রা করবে না। এদের সেন্স অব হিউমার খুব কম। একবার আত্না এসে তোমার উপর ভর করলে তখন টের পাবে। প্ল্যানচেট কোন ছেলে খেলা বিষয় নয়। অনেক সাধনার পর আমি এ বিদ্যা লাভ করেছি। এখানে ধৈর্য্য ধরে ধ্যান করতে হয়।

মিসেস গোমেজ পুনরায় চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় প্রলাপ শুরু করেন-আসেন আমার স্বামী, আপনি কোথায়। আমরা আপনার অপেক্ষায় বসে আছি।

অপালা নিজেও জানে না কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেখে বাইরে সকাল হয়ে গেছে। মোমদানিতে মোম পুড়ে শেষ। মিসেস গোমেজ সামনের সোফায় মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। অপালা চলে আসতে আসতে হাসি মুখে বলে- আন্টি, আঙ্কেল কি চলে গেছেন? ইস্। একটুর জন্য উনার সাথে দেখা হল না। পরের বার আসলে আমার তরফ থেকে সরি বলে দেবেন, প্লীজ।

অপালার কথা শেষ হবার আগেই মিসেস গোমেজ দুম করে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন।

Sunday, February 15, 2009

ভালোবাসা ও মৃত্যুর গল্প

এটা কি?
দেখতেইতো পারছ, আবার জনতে চাচ্ছ কেন।
তুমি এরকম কুৎসিত নোংরা একটা কুকুর ছানা নিয়ে ঘরে ঢুকেছ কেন?
রাস্তার কয়েকটা ছেলে মিলে বাচ্চাটাকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁস লাগিয়ে মারছিল। আমি গিয়ে নিয়ে এসেছি। বাচ্চাটা খুব অসুস্থ, এখন এটাকে ছেড়ে দিলে মরে যাবে। কয়েকটা দিন আমাদের এখানে থাকুক, তারপর সুস্থ হলে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসব।
জেনী প্রাণপন চেষ্টা করছে তার রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে-এক্ষুণি এটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আস।
ফয়সল কোন উত্তর দেয় না।
এখন ঝগড়া করতে ভালো লাগছে না। জেনী সামনে থেকে সরে আসে।

ফয়সল খেতে আস। জেনী টেবিলে ভাত দিয়ে ফয়সলকে ডাকতে আসে।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে জেনীর রাগ সপ্তমে চড়ে যায়। ফয়সল কুকুরের বাচ্চাটিকে সোফার উপর বসিয়ে রেখেছে।
ফয়সল জেনীর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে-আজকের রাতটা এটা এখানে থাকুক, কাল সকালে এটাকে বিদেয় করে দেব।

ফয়সল খেতে বসে। জেনী তুমি চোখ মুখ এমন শক্ত করে রেখেছ কেন। আরাম করে খাও। টেবিলে এই বাড়তি প্লেটটা কার জন্যে?
ওমা, আমাদের বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছেন। উনাকে ভাল মন্দ রান্না করে খাওয়াতে হবে না। এই প্লেটটা উনার জন্যে। তা কুকুর বাবু নিজে খেতে পারবে তো নাকি আমি খাইয়ে দেব।
জেনী তুমি খুব সামান্য একটি ব্যাপার নিয়ে হৈ চৈ করছ। একি ভাত না খেয়ে উঠে যাচ্ছ কেন?

জেনী হাত ধুয়ে কিচেনে চলে আসে। খাবার সব উঠিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পর ড্রয়িংরুমে উকি দিয়ে দেখে-ফয়সল হাতে একটি রুটির টুকরো নিয়ে কুকুরের বাচ্চাটিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কুকুরটি মানুষের এ ধরনের আচরণে অভ্যস্থ নয়। এটি আনন্দে কিছুক্ষণ পর পর কুঁই কুঁই শব্দ করছে।

ফয়সল সিগারেট ধরাতে বারান্দায় চলে আসে। জেনী একটা চেয়ারে বসে রয়েছে। জেনী এখানে বসে রয়েছ কেন, ঘুমুতে চল।
জেনী ঝটকা মেরে ফয়সলের হাত সরিয়ে দেয়। ফয়সল, তোমার ঢং দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। নিজের বাচ্চার প্রতি তোমার এত মমতা দেখিনি, যতনা তুমি একটা কুকুরের বাচ্চার প্রতি দেখাচ্ছ।
ফয়সল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জেনী আবার সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গটি তুলেছে। জেনী, আমি আগেও অসংখ্যবার বলার চেষ্টা করেছি, বাবুর মৃত্যুর উপর আমাদের কোন হাত ছিল না। তখন আমাদের আসলে কিছুই করার ছিল না।

ফয়সল-জেনীর দুই বছরের বাচ্চা তুষারের হঠাৎ করে একদিন রাতে শ্বাস কষ্ট আরম্ভ হয়। তাকে দ্রূত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। ফয়সল বেরিয়ে পড়ে গাড়ীর খোঁজে। দুই ঘন্টা ধরে চেষ্টা করেও কোন গাড়ী যোগাড় করতে পারে না। অনেকগুলি গাড়ী তার সামনে দিয়ে পানি ছিটাতে ছিটাতে চলে যাচ্ছে। ছিটানো পানিতে তার শরীর মাখামাখি। শেষ পর্যন্ত এক টেক্সিওয়ালাকে অনেক হাতে পায়ে ধরে রাজী করাতে পারে।
ফয়সল বাসায় ফিরে দেখে জেনী তুষারকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। ভঙ্গিটা দেখে তার বুক ধক্ করে উঠে। বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে দেখে গা বরফের মত ঠান্ডা।
তারপর থেকে কিভাবে যেন জেনীর মাথায় ঢুকে যায় ফয়সল যদি সময় মতো গাড়ী যোগাড় করতে পারতে তাহলে তাদের বাবুটাকে বাঁচানো যেত। তুষারের মৃত্যুর জন্য সে ফয়সলকে দায়ী ভাবতে শুরু করে।

ফয়সলের চোখে সে দিনের দৃশ্যটি ভেসে উঠে।
নিজ হাতে সে তুষারের কবর খুঁড়ছে। এটা নিযে পরে কত সমালোচনা হয়। এত লোক থাকতে বাবা কেন ছেলের কবর খুঁড়বে। এটা নিয়ম বর্হিভূত। হায়রে! মৃত্যুর পরও কত নিয়ম থেকে যায়।
সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। কবরের গর্তে পানি জমে যাচ্ছিল। ফয়সল সারা দুপুর পলিথিনে মোড়ানো তুষারের লাশ নিয়ে হাঁটু গেড়ে কবরের সামনে বসে থাকে। সৃষ্টিকর্তা সম্ভবত সেদিন ইচ্ছে করেই বৃষ্টি দিয়েছিলেন। বৃষ্টির পানি যাতে করে তার চোখের পানিকে ধুয়ে দিতে পারে।

জেনী চল। ফয়সল তার একটা হাত জেনীর কাঁধে রাখে।
তুমি তোমার কুত্তা নিয়ে ঘুমুতে যাও। তোমার পাশে তার বিছানা করে দেয়া হয়েছে-জেনী ঝাঁঝিয়ে উঠে।
ফয়সল বুঝতে পারে না কখন সে জেনীর গালে চড় মেরে বসেছে।

ফয়সল ড্রয়িংরুমে চলে আসে। কুকুরের ছানাটিকে তুলে নেয়। এটা সম্ভবত বুঝে ফেলেছে তাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসা হবে। দুই চোখে করুণ মিনতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

জেনী দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক দিন আগের একটি দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ফয়সল দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তার কোলে তুষারের মৃত দেহ। এ মুহুর্তে সামনের মানুষটিকে তার খুব অপরিচিত বলে মনে হতে থাকে। এত দিন ধরে তারা দুইজন এক সাথে রয়েছে তারপরও কেন তারা একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে না। দীর্ঘ দিন এক সাথে থাকার পরও একটা মানুষকে সম্ভবত কখনই পুরোপুরিভাবে জানা যায় না।

ফয়সল দাঁড়াও-জেনী পেছন থেকে ডেকে উঠে।
জেনীর কন্ঠশ্বরে এমন কিছু ছিল ফয়সল পেছনে ফিরে তাকায়।
জেনী এসে কুকুরের ছানাটিকে ফয়সলের হাত থেকে নিজের কাছে নিয়ে নেয়।
আই অ্যাম সরি ফয়সল। নিয়তির উপরে আমাদের আসলে কারোও হাত নেই। জীবনতো কারো জন্যে থেমে থাকে না। শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যায়।

আজকের দিনটির কথাই ধর। আমরা দুইজনেই প্রাণপনে আজকের দিনটির কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি কই। আমরা দুইজনেই জানি আমরা তা পারব না। কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। মিথ্যে ভান করে যাচ্ছি।
আজকের দিনেই আমাদের তুষার মারা যায়। কেন আমরা নিজেদের কষ্ট একজন আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারছি না।

ফয়সল জেনীর দুই কাধে হাত রাখে। তাকিয়ে থাকে জেনীর মুখের দিক। জেনীর মুখটা তার কাছে কেমন যেন খুব অপরিচিত বলে মনে হতে থাকে ।

Friday, February 13, 2009

অপার্থিব ভালোবাসা

জামিল আহমেদ রুনুকে বসতে নির্দেশ করেন।
আপনি এখন যা দেখবেন তা কেবলই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। বাস্তবের সাথে একে কম্পেয়ার করার কিছু নেই। আমি কি শুরু করব?
হ্যাঁ। রুনু সহজ ভাবে উত্তর দেয়।

আপনি এখানে বসুন প্লীজ।
অদ্ভুত দর্শন একটি চেয়ারে রুনু বসে পড়ে। জামিল আহমেদ এবার রুনুর হাতের বিভিন্ন অংশে অনেকগুলি সেন্সর লাগানো তার টেপ দিয়ে আটকে দেন। মাথায় হেলমেটের মতো দেখতে একটি জিনিস পড়িয়ে দেন। এতে রুনুর চোখ ঢাকা পড়ে যায়। এখন আর সে কিছু দেখতে পারছে না। কানের দুই পাশে লাগানো ইয়ার ফোনে জামিল আহমেদের ধাতব কন্ঠস্বর ভেসে আসে-আমরা শুরু করছি।

রুনুর কানের পাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। চোখের সামনে আবছা আবছা আলোতে বিচিত্র বর্ণের খেলা। গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা মনে হচ্ছে চারপাশের জগতকে। কুয়াশা ভাব ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করে। আবছা আবছা কিছু লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। এবার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কয়েক জনকে সে চিনতেও পারছে। তার আত্নীয় স্বজন। এরা সবাই তার বাড়ীতে কি করছে। ঘটনাটা যেন আগেও একবার ঘটেছে। মনে পড়ছে না।

দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। অনেক লোক একটি টেবিলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের মাঝখানে একটি কেক, কয়েকটি মোমবাতি জ্বলছে। সম্ভবত কারো জন্মদিন, কিন্তু কার?

সামনের দৃশ্য আবার বদলে যেতে শুরু করে। একটি ছোট ছেলে কেক কাটছে। পাশে তার মা দাঁড়ানো। ছোট ছেলেটি কাব্য, তার মা রুনু নিজেই। কাব্য একটি কেকের টুকরো তার মাকে খাওয়াচ্ছে। রুনু নিচু হয়ে তার মুখ ছেলের মুখের সামনে নিয়ে আসে। রুনুর মনে হচ্ছে তার শরীরের ভিতর দিয়ে হাজার ভোল্টের বিদ্যুত প্রবাহিত হচ্ছে। তার মুখে কাব্যের নিঃশ্বাস এসে পড়ছে। রুনু ছেলেকে চুমু খেল। তার প্রতিটি স্নায়ুতে কাব্যের স্পর্শ ছড়িযে পড়ছে। কাব্য দৌড়ে দু’তলা যাবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে, পেছনে তার মা। হঠাৎ পিছলে কাব্য পড়ে যায়। তার হাঁটু ছড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাঁথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেছে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটা হাত রুনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আম্মু আম্মু করে ডাকছে।

রুনু ছুটে যেতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। চোখের পানিতে তার দু’গাল ভিজে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই রুনু চিৎকার করে উঠে। চিৎকার করার সাথে সাথে আবার সব কিছু আগের মত হযে যায়। রুনু টের পায় মাথার উপর হেলমেটের মতো চেপে বসা যন্ত্রটি সরে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ লাগে রুনু বুঝে উঠতে সে কোথায় আছে। হার্ট বিট বেড়ে যাওয়াতে রুনু হাপাচ্ছে। চট করে গাল স্পর্শ করে দেখে তার দু’গালই ভেজা। সত্যিই সে কাঁদছিল। জামিল আহদমদ এগিয়ে এসে তার হাতের তারগুলি খুলে দেন।
তা আজকে কেমন লাগল আমাদের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এই জগত?
কথা বলতে রুনুকে প্রচন্ড মানসিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
আমার কাব্য ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে, তার সাহায্য দরকার।
রুনু, আমি আগেও বলেছি কাব্য বলে বাস্তবে কেউ নেই। সে শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এখানে প্রোগ্রামার যেভাবে প্রোগ্রামটি তৈরী করবেন আপনি সেভাবেই দেখতে পাবেন।

রুনু হাপাতে হাপাতে বলে পুরো ব্যাপারটি শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম হতে পারে না। আমার ছেলের স্পর্শ এখনও আমার গালে লেগে রয়েছে। আপনি আমাকে আমার ছেলের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
দেখুন রুনু, আমাদের তৈরী এই ভার্চূয়াল জগত আমাদের ব্যাবসারই একটি অংশ। এর মাধ্যমে আমরা মানুষকে বিনোদন দিয়ে থাকি। বিনিময়ে আমার টাকা পাই। কাউকে কষ্ট দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

আমার ছেলে কাব্য রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে আজ ছয়টা মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও আমি রাতে ঠিক মতো ঘুমুতে পারি না। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠি। মনে হয় আমার ছেলে দরজার বাইরে থেকে আমাকে ডাকছে। পরম মমতায় দরজা খুলে দেখি কোথাও কেউ নেই। এরপর সারা রাত আর ঘুমুতে পারি না। খালি মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েল আমার ছেলে এসে আমাকে না পেয়ে ফিরে চলে যাবে। তারপর একদিন আপনাদের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে চলে আসি। আপনারা যে ছেলেটিকে তৈরী করেছেন সে অবিকল আমার কাব্যের মতো। তার ভালোবাসার টানে আমি আজ এক সপ্তাহ ধরে রোজ এখানে ছুটে আসি। এই ছেলেটিকে আমি কাব্যের মতোই ভালোবাসতে শুরু করেছি। মনে হচ্ছে আমার কাব্যই আবার ফিরে এসেছে।

জামিল আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঠিক আছে এবার আমি আপনাকে প্রোগ্রামের বাকী অংশটুকু দেখাচ্ছি। তবে আপনি তা না দেখলেই ভাল করতেন।

রুনু আবার গিয়ে আগের চেয়ারটিতে বসে পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই রুনু পৌছে যায় ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে। আগে যেখানে শেষ হয়েছিল এবার তার পর থেকে শুরু হয়। রুনু কাব্যকে মেঝে থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। রুনু কাঁদছে। ছেলের মুখে হাসি।

এবার দৃশ্যপট সম্পূর্ন বদলে যেতে আরম্ভ করে।
রাতের সময় একটি গাড়ী রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। গাড়ী চালাচ্ছে কাব্যের বাবা জয়। রুনু পিছনের সিটে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। কাব্য ঘুমিয়ে পড়েছে। রুনুর চোখেও ঘুম। জয় ঘন ঘন হাই তুলছে। হঠাৎ কয়েক মুহুর্তের জন্য ঝিমুনি এসে পড়ে। এই কয়েক সেকেন্ডেই গাড়ী রাস্তা থেকে পাশের মাঠে ঢুকে পড়ে। জয় স্টিয়ারিং এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ী নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই পাশের এক গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। তারপর শুধু কাঁচ ভাঙার শব্দ।

আবার দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে।
রুনুর জ্ঞান ফিরে আসছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। মাথাটা মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ে যাবে। সামনে জয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সামনে ড্যাশবোর্ডে তার মাথা ঠুকে আছে। কাব্যের শরীরের নিচের অংশটা এখনও রুনুর হাতে ধরা রয়েছে। কিন্তু উপরের অংশটুকু গাড়ীর জানালার কাচ ভেঙে বাইরে বের হয়ে রয়েছে। মাথাটা থেতলে গেছে। রুনুর গলা দিয়ে জবাই করা পশুর চিৎকার বেরিয়ে আসে। হঠাৎ করে রুনু বাস্তবতায় ফিরে আসে । সামনে জামিল আহমেদের ভীত মুখ আবিস্কার করে। তার মানে আসলেই সে এতক্ষণ চিৎকার করছিল। রুনু উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। সে রীতিমতো টলছে। ধপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ে।

জামিল আহমেদ এগিয়ে আসেন। আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন। রুনু মাথা নাড়ে। কোন মতে উচ্চারণ করে আমার ছেলে আবার মারা গেছে।
জামিল আহমেদ এক গ্লাস পানি রুনুর দিকে এগিযে দিয়ে বলেন- আপনার কাব্যের মৃত্যূ একবারই হয়েছে। এখন যে মারা গেছে সে আপনার ছেলে নয় । শুধুই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। আমি এজন্যেই আপনাকে এ অংশটুকু দেখাতে চাচ্ছিলাম না।

আমি কি আবার আমার ছেলেকে দেখতে পারি।
জামিল আহমেদ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে রুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। না আপনি আর এই জগতে ঢুকতে পারবেন না। আমার প্রোগ্রামটি নষ্ট করে ফেলেছি। আপনার জন্য আমাদের তৈরী করা প্রোগ্রামের এটাই ছিল শেষ অংশ। আমাদের প্রোগ্রাম এখানেই শেষ।

রুনু কিছুক্ষণ জামিল আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
জামিল সাহেব আপনি এক সন্তান হারা মাকে তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছেন। হোক তা ক্ষণিকের কাল্পনিক ভালোবাসা। আপনাকে ধন্যবাদ। এই টুকু বলে রুনু চলে আসে।

জামিল আহমেদের মনটা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। একজন মার সাথে তিনি প্রতারণা করেছেন। প্রোগ্রামটা আসলে নষ্ট করা হয়নি। সম্পূর্ন অক্ষত আছে। এটা করা ছাড়া আসলে উনার কোন উপায় ছিল না। রুনু কাল্পনিক জগতের কাব্য নামক এক চরিত্রকে ভালোবাসতে শুরু করে ছিল। কাল্পনিক এই কাব্যকে বাস্তব জগতের তার ছেলে কাব্যের সাথে মেলাতে চেষ্টা ক

রছিল। এ এক অপার্থিব ভালোবাসা। এত করে শুধু তার কষ্টটুকুই বাড়ত। তারচেয়ে বরং এটাই ভাল হয়েছে। পার্থিব এই জগতে অপার্থিব ভালোবাসার কোন স্থান নেই।

Wednesday, February 11, 2009

অপেক্ষা


জ্যামি পাথরের মূর্তির মতো তার বাবার সামনে বসে আছে। কী নিশ্চিন্তেই না তার বাবা শুয়ে আছেন। একটু আগে কি ভয়ানক ম্বাস কষ্টটাই না তার শুরু হয়েছিল। গলার রগ ফুলে উঠেছিল। সারা শরীর মৃত্যূ যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন সব কেমন নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে চারদিকে কোথাও যেন আর কেউ নেই।
তার মনে পড়ে না আগে কখনও এভাবে সে তার বাবার পাশে এসে বসেছে কিনা। অন্য সময় হলে সে অস্বস্তিতে মরে যেত। বাবা-ছেলের সহজ সম্পর্ক তাদের মধ্যে কখনও ছিল না। তার বাবা কখনও তাকে জোরে একটা ধমক পর্যন্ত দেননি। অথচ তারপরও বাবার সামনে আসলে তার গলা শুকিয়ে যেত।
জ্যামি আসলে বড় হয়েছে একটা ঘোরের মধ্যে। তার ছিল নিজের তৈরী অন্য একটি জগত। সে কখনও তার চেনা সেই জগতের বাইরে আসতে চায়নি। তার বাবাও ছেলের এই ভুবনে প্রবেশের চেষ্টা করেননি। জ্যামিও তার এই ঘর থেকে কখনো্ মুক্তি চায়নি। ফলে নিজের অজান্তেই তারা একটু একটু করে একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।
অথচ আজ মৃত্যর মতো অসম্ভব এক কুৎসিত জিনিস তার এত দিনের তৈরী শৃঙ্খল থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছে। অদৃশ্য ঘরের দেয়াল ভেঙে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
জ্যামি খুব ধীরে তার বাবার কপালে হাত রাখে। ফিসফিস করে বলতে থাকে-হে করুনাময় আমার বাবার প্রতি একটু দয়া করো। জ্যামি খুব শক্ত করে তার বাবাকে ধরে রাখে। মৃত্যূকে পরাজিত করার এক ছেলেমানুষী প্রচেষ্টা।
রাতের আধাঁরে সব কিছু কেমন ভীতিকর মনে হয়। জ্যামি ভোরের অপেক্ষা করতে থাকে। সে জানে না নতুন একটা ভোর তার জন্যে কি নিয়ে আসছে।
জ্যামি বুঝতে পারে না কখন মৃত্যু এসে চুপিচুপি তাকে পরাজিত করে গেছে। জ্যামির বাবা মারা যান ৪.৩০ মিনিটে। নিঃশব্দ এক মৃত্যূ। বাইরে ভোরের তখনও অনেক দেরী।