Thursday, June 5, 2008

পাঠকের কাঠগড়ায়

ঈশ্বরের বিচার সভা। বিচারের কাঠগড়ায় দাড়ানো একজন মানুষ। স্বর্গ এবং নরকের দেবদূতরা নিজ নিজ পক্ষের যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করছেন।
স্বর্গের দেবদূত: মাই লর্ড, এই লোককে অবশ্যই স্বর্গে পাঠানো উচিত। জীবিত অবস্থায় এই লোক একজন লেখক ছিল। এই লোক তার লেখনি দিয়ে অনেক লোককে হাসিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে। সে মারা গেছে কিন্তু তার লেখা এখনও জীবিত রয়েছে। যা দ্বারা মানুষ তার মৃত্যুর পরও তাকে মনে রাখবে, তার লেখা পড়ে আনন্দ পাবে। তার মৃত্যুর পরে অনেক ভক্ত কান্নাকাটি করেছে। অনেক মানুষের শুভ কামনা রয়েছে তার জন্যে । অতএব এমন জনদরদী একজন লোকের জন্যে স্বর্গই উপযুক্ত স্থান হওয়া উচিত।

নরকের দেবদূত: মাই লর্ড, আমি আমার প্রতিপক্ষের সাথে একমত হতে পারছি না। এই লেখক ভদ্রলোক তার লেখা দিয়ে অনেক মানুষকে কাঁদিয়েছে, অনেককে রাগিয়েছে। অনেকের মনে দুঃখ দিয়েছে। সে মারা গেছে কিন্তু তার অত্যাচার বন্ধ হয়নি, কারণ তার লেখা এখনও বেঁচে রয়েছে। তার মৃত্যুর পর এখন থেকে তাদের আর জঘন্য সব লেখা পড়তে হবে না ভেবে অনেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে । এখনও লোকজনের বিতৃষ্ণা তার উপর বর্ষিত হচ্ছে। এমন একজন বিতৃষ্ণা উৎপাদনকারী লোকের জন্যে নরকই উপযুক্ত স্থান হওয়া উচিত।

ঈশ্বর পড়লেন খুব সমস্যায়, দুই পক্ষের বক্তব্যেই যুক্তি আছে। শেষ পর্যন্ত যম দূতকে খবর পাঠালেন। এই লোককে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠানো হবে। কিছুদিন তাকে অবর্জাবেশনে রেখে দেখা হবে, তার জন্যে স্বর্গ না নরক কোনটা উপযুক্ত হবে।

এতক্ষণ লোকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার হাত জোর করে বলে উঠে, মহামাণ্য আমাকে যদি পুনরায় পৃথিবীতে পাঠাতে চান তবে দয়া করে লেখক বানিয়ে পাঠাবেন না। কারণ পাঠকের কাঠগড়া আপনাদের এই কাঠগড়ার চেয়েও ভয়াবহ। যা আমি জীবিত অবস্থায় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। লেখকের কোন লেখা ভাল লাগলে পাঠকরা তাকে মাথার উপর বসিয়ে রাখবে আর দুঃভাগ্যক্রমে কোন লেখা মনঃপুত না হলে তাকে নর্দমায় ছুড়ে ফেলবে। লেখকেরা যেন মানুষ নয় লেখা ছাপানোর মেশিন। এদের জন্মই হয়েছে মানুষকে অনন্দ দেবার জন্যে। যেন লেখকের নিজস্ব কোন ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অনুভুতি থাকতে পারে না।

অতএব আমার বিনীত প্রার্থনা হচ্ছে, আমাকে গাধা-খচ্চর যা খুশি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠান আমার আপত্তি নেই, কিন্তু দয়া করে পুনরায় লেখক বানিয়ে পাঠাবেন না।

আমাদের প্রজন্ম

ভাষা শহীদ রফিকের আবেদন ঈশ্বর শেষ পর্য়ন্ত মঞ্জুর করেন। এক দিনের জন্যে তিনি বাংলাদেশ দেখে যাবেন। যে ভাষার জন্যে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সে ভাষার এতদিনে কতটুকু উন্নতি ঘটেছে তা দেখাই উনার উদ্দেশ্য।
প্রথমেই তিনি চলে আসেন বাংলা একাডেমিতে। এখন সেখানে বই মেলা চলছে। মেলার গেইটে পাঠকের দীর্ঘ লাইন। প্রশান্তিতে শহীদ রফিকের বুক ভরে যায়।
মেলায় প্রবেশ করেই তিনি ভ্যবাচেকা খেয়ে যান। সম্ভবত ভুল করে তিনি কোন কমিউনিটি সেন্টারে চলে এসেছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। চারদিকে হলুদ পাঞ্জাবি পড়া ছেলে আর হলুদ শাড়ী পড়া মেয়েদের ছড়াছড়ি। সম্ভবত এরা বর পরে লোকজন। কিন্তু সবাই একই রঙের এতগুলি পোষাক কোথা থেকে যোগাড় করেছে। স্টেজে বর কনে সেজে বসে আছে, পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
এটা কি ধরণের বিয়ে রে বাবা- শহীদ রফিক বুঝতে পারেন না। একটু খোঁজ করতে গিয়ে উনার ভুল ভাঙে। এখানে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। দেশের একজন প্রখ্যাত লেখকের বই এর পাবলিসিটি চলছে।
গভীর বেদনা নিয়ে শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। সবাই লাইন দিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বই কিনছে। বাচ্চারা কিনছে ভূত-পেত্নীর বই। এক সময় এই বাচ্চারা বড় হবে ভূত-পেত্নীদের সাথে নিয়ে। যে ভাষায় তারা কথা বলছে সেই ভাষার পেছনে যে আমাদের এক গৌরবময় ইতিহাস জড়িত এটা তাদের জানানোর চেষ্টা কেউ করছে না। তাদের জন্যে এ ধরনের তেমন কোন বইও নেই। শহীদ রফিক মন খারাপ করে মেলা থেকে বেরিয়ে যান।
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন শহীদ মিনার চত্বরে। যেখানে এক সময় এই ভাষার জন্যে উনার মতো আরও অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। চারদিকে নোংরা কাগজপত্র পড়ে আছে। ঝাড়ু– দেয়ার কেউ নেই। খালি কয়েকজন ফেরিওয়ালা ঘোরা ফেরা করছে। শুধু মাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২ টার পর থেকে এখানে লোকজনের ঢল নামে। খালি পায়ে কার আগে কে গিয়ে শহীদ মিনার চত্বরে ফুল দিবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
এবার তিনি চলে আসেন দেশের এক নামকরা প্রইভেট ইউনির্ভাসিটিতে। এখানকার ছেলে মেয়েরা বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে এক অদ্ভূত ভাষায় কথা বলছে। এ নতুন ভাষা তারা কোথা থেকে আমদানি করেছে তিনি বুঝতে পারছেন না। সময়ের সাথে দেশের পরিবর্তন ঘটতে শুনেছেন, তার সাথে কি ভাষারও এত পরিবর্তন ঘটে তিনি জানেন না। এখানকার ছেলে মেয়েদের কাছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে চাওয়া রীতিমতো দুঃসাহসের ব্যপার। কারণ এরা ডিজুস নামক এক নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়ে। তিনি এই প্রজন্মের সাথে পরিচিত নন।
শহীদ রফিক সেখান থেকে সরে আসেন। এবার তিনি চলে যান পাবলিক লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে প্রচুর বই, কিন্তু পড়ার লোক নেই। কিছু পাঠক আছে । এর মধ্যে কয়েকজন পড়ছে বাকীর অলস সময় কাটাচ্ছে। আজকালকের প্রজন্মের ছাপার অরে বই পড়ার সময় খুব কম। তাদের বেশীর ভাগ সময় কাটে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটে।
শহীদ রফিক একসময় চলে আসেন গুলশান এলাকায়। রাস্তার পাশে অসংখ্য চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর ফাস্টফুডের দোকান। কি সব বাহারী তাদের নাম, উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে আসে।
বুকে গভীর কষ্ট নিয়ে শহীদ রফিক ফিরে যাচ্ছেন। বিষাদে মন ছেয় আছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। যে দেশে এক সময় ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল ভাষার জন্যে, তাদের দেশের জন্যে, আজও ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়ে লড়াইয়ে তবে তা দেশের জন্যে নয় হলের সিট দখল করার জন্য। যে দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা শুদ্ধ ভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারেন না, সে দেশ থেকে এর বেশী আর কিছু আশা করার নেই।
খুব লজ্জা নিয়ে শহীদ রফিক ঈশ্বরের কাছে ফিরে যান। উনার দেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কি উত্তর দেবেন?

ঈশ্বর মৃদু হাসেন। ইশারা করেন নীচের পৃথিবীতে। তাকিয়ে দেখ ঐসব ছোট বাচ্চাদের দিকে যারা ফুল নিয়ে এসে ভিড় করেছে শহীদ মিনারে। এরা কোন রাজনৈতিক দলের কেউ না। নোংরা রাজনীতি এখনও এদের স্পর্শ করতে পারেনি। এই প্রজন্ম একসময় বড় হবে। এরা তাদের বুকে লালন করবে ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা। কারণ, সত্যিকারের আত্নত্যাগ কখনও বিফলে যায় না। একে অস্বীকার করবে, এত বড় ক্ষমতা দিয়ে আমি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাইনি।

উড়ে যায় বলাকা

মা তার বাচ্চাকে কোল নিয়ে খুব আগ্রহ করে তাকিয়ে আছে। সামনে ছেলের বাবা পশু জবাই করছে। অসহায় একটি পশুকে বেঁধে ফেলে গলায় ছুরি চালানো হচ্ছে। পশুটির দু চোখে বেঁচে থাকার সীমাহীন আকুতি।
বোবা প্রাণীটি সম্ভবত বলতে চায়, আমরা নির্বোধ পশু কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন।
কাটা গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে বাবার সমত্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে। গলা কাটা পশুটি ব্যথার যন্ত্রনায় ছটফট করছে। এক সময় পশুটির সমত্ত দেহ নিথর হয়ে আসে।
বাবার চোখে বিজয় আনন্দের উল্লাস। মার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এই দৃশ্য দেখে এক সময় তার ছেলেও বাবার মতই সাহসী হবে। ছেলের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু তার অবচেতন মনে ঠিকই সম¯ত্ত ঘটনাটি গেঁথে যায়।

২৫ বছর পর নির্জন এক রাস্তায় ছেলেটি এক নিরীহ লোককে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। লোকটি দেশের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। ছেলেটির তা জানার কথা নয়। জানার কোন মাথা ব্যথাও তার নেই। ছোট বেলায় দেখা এমনই একটি কাছাকাছি ঘটনার স্মৃতি ছেলেটির অবচেতন মনে ছায়া ফেলে। ছেলেটি ঠিক মনে করতে পারে না। মনে করার তার সময়ও নেই। খুব দ্রুত কাজ শেষ করে তাকে চলে যেতে হবে।
লোকটির দু চোখে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি। উনিতো করো কোন ক্ষতি করেননি, তাহলে কেন উনার প্রতি পশুর মতো এমন একটি আচরণ করা হচ্ছে। বিড় বিড় করে বলতে চেষ্টা করেন, হে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন।

সীমাহীন স্বচ্ছ নীল আকাশে একটি বলাকা উড়ে যাচ্ছে। নীচে রাজ পথে পড়ে আছে এ দেশেরই এক সাংবাদিকের রক্তাত দেহ। যিনি এক সময় দেশের জনগনের জন্যে কলম তুলে নিয়েছিলেন। উনার কলমের কালি এক সময় দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে। আজ উনার রক্তেই দেশের জনপদ স্নাত হচ্ছে।

মোবাইল ফোন

দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় মোবাইল কোম্পানীর গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। চোদ্দ কোটির দেশে শুধু একটি কোম্পানীর গ্রাহক সংখ্যাই এক কোটি। কে বলে আমাদের দেশ গরীব। ঐ মোবাইল কোম্পানীটি আমাদের দেশকে এক দশকে কোথায় পৌছে দিয়েছে এটা তারা বেশ ফলাও করে প্রচার করছে। মোবাইল ফোন আসার পর দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু মোবাইল কোম্পানীগুলি গ্রাহকের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজেদের স্বার্থ দেখতেই বেশী ব্যস্ত থাকে।
একবার এক দৈনিক পত্রিকা দেশের কিছু বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি কাল্পনিক গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। যার বিষয়বস্তু ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোনের ব্যবহার।

নিচে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্যসমূহ তুলে ধরা হল-
সাবেক প্রধানমন্ত্রী : বর্তমান সরকারের আমলে ভিক্ষুকের হাতেও শোভা পাচ্ছে মুঠোফোন। এটাই প্রমান করে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। আর এই সাফল্য এসেছে একক ভাবে আমাদের চেষ্টায়। এই সরকার আবার ক্ষমতায় এলে ইনশাল্লাহ মানুষের দুই হাতে দুটি মোবাইল শোভা পাবে। বিরোধী দল আমাদের এই উন্নয়নে বাধা দিলে এর সমুচিত জবাব দেয়া হবে।

সাবেক বিরোধী নেত্রী : বর্তমান সরকারকে রক্ত চোষা ভ্যাম্পায়ারের সাথে তুলনা করা চলে। ভিক্ষুকরাও এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দেশের মানুষ খেতে পাচ্ছে না আর সরকার মোবাইল ফোন নিয়ে বিলাসিতা করছে। আসুন আমরা সরকারের এই চক্রন্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই। আর সবাই মিলে শ্লোগান তুলি-
ভাত নাই পেটে-
মুঠোফোন ফোন আছে হাতে।

সাবেক মহাসচিব : দেশের আনাচে কানাচে আমরা যে ভাবে মুঠোফোন পৌছাই দিছি তা কল্পনারও অতীত। এখন বিরোধী দল দাবি করছে এই কৃতিত্ব তাদের একার। তারা ভাল কইরাই জানে তাদের এই দাবির কোন ভিত্তি নাই। এটাতো হইল গিয়া এই এরকম যে, বিচার মানিলাম কিন্তু তাল গাছটা আমার।

সাবেক বিরোধী দলীয় মহাসচিব : দেশে মুঠোফোনের ব্যবহার যে ভাবে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে করে দেশের যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। তারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করছে। বাপের পকেটের টাকা চুরি করে ফোনের বিল দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যত ধ্বংসের মুখে পড়বে। আমি বর্তমান সরকারের প্রতি আনুরোধ করব আপনারা অচিরেই এই ধ্বংসের খেলা বন্ধ করেন, নচেত হরতাল ডেকে দেশ অচল করে দেয়া হবে। দেশের জনগণ আমাদের সাথে আছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : দেশ চালাবার কাজে মুঠোফোন খুব ইম্পর্টেন্ট ভূমিকা রাখছে। প্রিভিয়াস সরকারের আমলে যোগাযোগের জন্যে আমাদের মান্ধাতা আমলের টি এন্ড টি ফোনের উপর ডিপেন্ড করতে হত। কিন্তু আমাদের সরকারের আমলে আমরা আধুনিক সিস্টেম মোবাইল ফোনের প্রচলন করেছি । এতে করে আমাদের ফোর্সরা অল টাইম আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছে। লেট সি, দেখি মুঠোফোনকে আর কি কি কাজে ইউটিলাইজড করা যায়।

সাবেক আইনমন্ত্রী : আমি এটাকে মুঠোফোন বলব না। কারণ আগে আমাদের দেখতে হবে এটাকে মুঠোফোন বলা যায় কিনা। এ ব্যপারে সংবিধানে কি বলা আছে। সংবিধান বর্হিভূত কোন কিছু তো আমরা করতে পারি না। কারণ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমি তো বুঝতে পারছি না বিরোধী দলের সমস্যাটা কোথায়।

সাবেক ধর্মমন্ত্রী : এটা হচ্ছে খৃস্টান ইহুদীদের তৈরী একটা জিনিস। প্রত্যেক মুমিন বান্দার প্রয়োজন এটাকে বর্জন করা। প্রাক ইসলামিক যুগে কোন টেলিফোন ছিল না, তারপরও মানুষের খবর আদান প্রদানে কোন সমস্যা হয়নি। সময় একটু বেশী লাগত এই যা। মাফ করবেন, আমার এই মাত্র একটি কল এসেছে, সম্ভবত ম্যাডামের। আমি কথা বলে আসছি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী : বাংলাদেশ অর্থনীতিতে দিনকে দিন আগাই যাচ্ছে। সেই দিন আর বেশী দূর নাই যেই দিন দেশের প্রত্যেইক নাগরিকের হাতে হাতে শোভা পাইবে মুটোফোন। এর থেইকা হামরা যে টেক্স পাইব তা দারাই দেশের অর্থনীতির চাক্কা বনবন কইরা ঘুরতে শুরু কইরা দিবে।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী : দেশের লোকজন মার্কেটগুলিতে যে ভাবে লাইন দিয়ে মোবাইল ফোন কিনছে যা ইউরোপ আমেরিকার মার্কেটগুলিতেও দেখা যায় না। আল্লাহর অশেষ রহমতে আর আমাদের দলের দোয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে।

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী : বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটির উপরে। আগামী এক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা গিয়ে দাড়াবে দশ কোটির উপরে। পরের বছর গিয়ে এই সংখ্যা দাড়াবে বিশ কোটি। তার পরের বছর-------

সাবেক বিদ্যুতমন্ত্রী : বর্তমানে মোবাইল ফোন আমাদের দেশের এক নম্বর সমস্যা। কারণ যেভাবে আমাদের দেশে ফোনের সংখ্যা বাড়ছে এতে করে এই ফোনগুলি চার্জ করতে দেশে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুত ঘাতটি দেখা দিচ্ছে। এটাই এখন লোডশেডিং এর অন্যতম প্রধান কারণ। আমি অনেক কষ্ট করে এই মূল্যবান তথ্যটি আবিস্কার করেছি।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মোবাইল কোম্পানীগুলি যে ভাবে ফ্রি কলের অফার দিচ্ছে এতে করে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলছে যা তাদের মস্তিষ্কের সেল গুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশে পাগলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার পরিবর্তে মোবাইল কার্ড কিনছে । ফলে দেশের লোকজন অপুষ্টিতে ভূগছে।

অবশেষে মুঠোফোনের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর তর্ক বিতর্কের পর কোন ধরনের মিমাংসা ছাড়াই গোল টেবিল বৈঠকের সমাপ্তি ঘটে। বর্তমানে সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল কাজ হচ্ছে সরকার এবং বিরোধী দলকে এক সাথে বসতে রাজী করানো এবং কোন একটি ব্যাপারে একমত হওয়া।

পরাধীনতা

মরুভূমির তপ্ত বালিতে এক ইরাকি মহিলা শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন ঠিক না, শুতে বাধ্য হয়েছেন। মর্টারের গোলার আঘাতে তিনি মারাত্নক ভাবে আহত হয়েছেন। অনবরত রক্তরণ হচ্ছে। রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মরুভূমির বালি তা শুষে নিচ্ছে। তিনি জানেন মৃত্যু আসছে খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে। নিজের জন্যে তার খারাপ লাগছে না, তার পরিবারের সবাই বোমার আঘাতে মারা গেছে, একা তিনি কার জন্যে বেঁচে থাকবেন। খারাপ লাগছে তার অনাগত শিশুর জন্যে, যে আর কয়েকদিন পরই এই পৃথিবীতে আসত।
মা, মা ডাকে তিনি চমকে উঠেন, কে ডাকছে?
মা আমি, তার ভ্র“ণ তার সঙ্গে কথা বলছে!
একি তার অবচেতন মনের কল্পনা, নাকি বাস্তবেই এটা ঘটছে? তিনি তার সন্তানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন।
মা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ?
হ্যাঁ, ছোট্র সোনা, আমি শুনতে পারছি।
মা, তুমি কি মারা যাচ্ছ?
আমি জানি না সোনা।
তুমি মারা গেলে কি আমিও মারা যাব মা ? এই পৃথিবী দেখতে পারব না।
ছোট্র সোনা আমার, তুমি এই ভয়ানক পৃথিবীতে এসে কি করবে? চারদিকে এত যুদ্ধ!
যুদ্ধ কেন হচ্ছে মা ?
এক মুহুর্তের জন্যে তিনি থমকে যান। আসলে কেন হচ্ছে এই যুদ্ধ? কিসের জন্যে? এক ফোঁটা তেলের জন্যে কয় ফোঁটা রক্ত ঝরছে, কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে!
সারা শরীর তার অবসাদে ভেঙে আসছে।
ছোট্র মানিক আমার, তুমি শান্তিতে ঘুমাও, আমি ঘুম পাড়ানি গান গাই। কিন্ত কোন ঘুম পাড়ানি গানই তার মনে আসছে না।
এ মুহুর্তে বুশ নিশ্চয় তার ফার্ম হাইজে অবকাশ যাপন করছেন। মার্কিন-ব্রিটিশ শিশুরা হয়ত কম্পিউটারে যুদ্ধের গেইম খেলতে ব্যস্ত। অথচ তাদের মতো সাধারণ লোকের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে কঠিন বাস্তবতা। এক সময় হয়ত এ যুদ্ধ থেমে যাবে, কিন্তু তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ কি কখনও শেষ হবে ? সে যুদ্ধ ক্ষুধার যুদ্ধ, দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ!
মা, মা আমি তোমাকে দেখতে চাই মা !
তার বাচ্চা এ পৃথিবীতে আসার জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি ফিসফিস করে বাচ্চাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনানোর চেষ্টা করছেন। তার বাচ্চার এ ঘুম আর কখনও ভাঙবে না।
মরূভূমিতে দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসে। এক সময় রাতের আঁধার কেটে গিয়ে দিনের আলো ফুটবে, কিন্তু সেই আলো তিনি দেখতে পাবেন না। তার বাচ্চা দেখতে পাবে না। কিছু রাত আছে যার কোন ভোর নেই।

(বেশ কিছুদিন আগে ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ চলাকালীন সময় পত্রিকায় আমি এক ইরাকী আত্নঘাতী হামলাকারীর খবর পড়ি, সেই হামলাকারী ছিলেন একজন মহিলা এবং তিনি ছিলন গর্ভবতী। ব্যপারটা বুঝতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। যুদ্ধ একটা মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়!
বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা একটা অস্থির সময় কাটাচ্ছি, তারপর ইশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার জন্ম ইরাকের মত কোন পরাধীন রাষ্ট্রে না হয়ে একটি স্বাধীন দেশে হয়েছে।
সপ্ম্প্রতি আমেরিকায় পোষা প্রাণীদের বিনোদনের জন্যে কিছু ক্লাব খোলা হচ্ছে। উত্তম প্রস্তাব। আমি খুব আশাবাদী, কারণটা ব্যাখা করছি-
ছোট বেলায় কবি জীবনান্দ দাশের একটি কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম-
আমি আবার আসিব ফিরে, এই ধাঁনসিড়িটির তীরে
হয়ত শালিক, নয়ত কোন শঙ্খচিলের বেশে।
পরজন্মে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব আমাকে যদি আবার পৃথিবীতে পাঠানো হয় তবে যেন আমার জন্ম ইরাকের মাটিতে না হয়। আমেরিকার মাটিতে, অন্তত মানুষ না হলেও কুত্তা (কুকুর সমাজ মা করবেন) হিসেবে।
আমি আবার আসিব ফিরে, এই পৃথিবীতে
হয়ত মানুষ, নয়ত কোন আমেরিকান কুত্তার বেশে।

প্রবাস

আমি আগেই জানতাম এ রকম একটা কিছু হবেই, কিন্তু তোর বাবা তো শুনল না, আমেরিকান ছেলে দেখে মজে গেল। ছোটলোকের বাচ্চা- এনগেজমেন্ট এর দিন কেউ এভাবে বিয়ে ভেঙে দেয়। আরে বান্দর, তোর গলায় কি আর মুক্তার মালা মানাবে।-মিলির খালা এক নিশ্বাসে কথা কটি বলে দম নেন।
মিলি মনে মনে তিন বার উচ্চারণ করে, মুটকি- মুটকি- মুটকি-এটা মিলির রাগ কমনোর নিজস্ব পদ্ধতি। মিলির বিয়ের ব্যাপারে এই খালার উৎসাহই ছিল সবচেয়ে বেশী।
নতুন ম্যাজেশিয়ানের পকেটে যেমন সব সময় এক প্যাকেট তাস থাকে, তেমনি মিলির এই মুটকি খালার হাত ব্যাগে সবসময় থাকবে এক গাদা পাত্র-পাত্রীর ছবি। সুযোগ পেলেই এই মহিলা উনার তাসের খেলা দেখাতে শুরু করে দেন। প্রথমে ব্যাগ খেকে বের হবে জোকার-অর্থাৎ সাধারণ মানের পাত্র-পাত্রীর ছবি, তারপর রাজা-রানী এবং সবশেষে টেক্কা। আগের ছবিগুলি দেখে কেউ যদি হাল ছেড়ে দেয়া শুরু করে তখন খালা টেক্কাগুলি ফেলে বিজয়ীর বেশে দর্শকের দিকে তাকাবেন। এরা উনার দৃষ্টিতে সেরা মানের পাত্র-পাত্রী। এ রকমই এক টেক্কা (আমেরিকা প্রবাসী ছেলে)-র সাথে তিনি মিলির বিয়ে ঠিক করেছিলেন।
লজ্জায় মিলি চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
আজ সকালে ছেলের মা ফোন করেছিলেন-ছেলে তিন মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল, ইচ্ছে ছিল এর মধ্যে মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে পরবর্তীতে এসে বউ নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ কি এক জরুরী কাজে তাকে আমেরিকা ফিরে যেতে হচ্ছে। মিলির খালার ধারণা এটা তাদের ছেলেকে বিয়ে না করানোর একটা অজুহাত। মিলির খালার বোধ হয় আরও কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিলির মা এর কারণে বলতে পারেন না। মিলির ধারণা তার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা দের একজন। নিজের সন্তানের যে কোন বিপদে তিনি সবসময় তাদের আগলিয়ে রেখেছেন। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু তিনি মিলিকে কিছু বুঝতে দিচ্ছেন না। যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। ধীরে ধীরে এক সময় মিলি সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করে।
এর কিছুদিন পরে আমেরিকা থেকে মিলির নামে একটা চিঠি আসে-

মিলি,
প্রথমেই তোমাকে তুমি করে বলার জন্যে মা চাচ্ছি। তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট হবে তাই তুমি করেই বলছি। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আমি হাত জোর করে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। বিয়ে ভেঙে দেয়াটা ছিল আমার একক সিদ্ধান্ত, আমার পরিবারের কোন ভূমিকা এখানে ছিল না। এর কারণটা বলার জন্যেই তোমাকে চিঠি লেখা, ব্যাখাটা তোমার কাছে গহণযোগ্য মনে হবে কিনা আমি জানি না। তারপরও বলছি-
আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রবাসে। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হীন এক নিঃসঙ্গ জীবন। দেশ থেকে চিঠি আসলে বেশির ভাগই আমি পড়তাম না, কারণ সেগুলিতে টাকা পাঠানোর তাগিদ ছাড়া আর
কিছুই থাকত না। কারো পরীক্ষার ফি, কারো ব্যাবসার জন্যে টাকা, কারো বা চিকিৎসার খরচ। আমি যেন টাকা পাঠানোর একটা মেশিন ছাড়া আর কিছু না। মনে পড়ে প্রথম যেদিন দেশে ফোন করি বাবা ফোন ধরেন। এত দিন পর দেশ থেকে পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নিজের অজাত্তেই আমার চোখ ভিজে আসে। বাবা প্রখম যে কথাটি বলেন তা হচ্ছে তুই টাকা পাঠাতে এত দেরী করছিস কেন? আমারতো এখানে প্রচুর দেনা, এত টাকা খরচ করে তোকে বিদেশে পাঠালাম। ফলে দেশে আসার আগ্রহ আমি কখনই অনুভব করিনি।
দীর্ঘ এক যুগ পর আমি দেশে আসি। তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখি সেদিন আমি একটা ধাক্কার মত খাই। আমার তখন মনে হয়েছিল পুথিবীর সবচেয়ে রুপসী তরুণীটি আমার সামনে বসে আছে। কেন যেন তখন আমার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। নিজেকে তখন বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট এর সেই দৈত্যের মত মনে হচ্ছিল। তখন মনে হল ইচ্ছে করলেই আসলে সব কিছু আবার আগের মত নতুন করে শুরু করা যায় না। সময় সব কিছু বদলে দেয়। আমি ইচ্ছে করলেই এখন পুথিবীর সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের গাড়ীটি কিনে ফেলতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই নিজের বয়সের চেয়ে অর্ধেক বয়সের তরুণীর হাত ধরে ভালবাসার কথা বলা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সময়টুকু আমি অনেক আগেই পার করে এসেছি।
যাক্ চিঠি আর দীর্ঘ করছি না। হঠাৎ করে আজ কেন যেন তোমাকে লিখতে ইচ্ছে হল তাই এই চিঠি লেখা। নিজের সমস্যার কথা আসলে অন্যকে বলতে ভাল লাগে না।
মিলি বেঁচেঁ থাকাটা বোধ হয় খুব একটা খারাপ না, যদি নিজের মত করে বেঁচে থাকা যায়। এই যে আমার একাকী জীবন এটাকে এখন আর খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। কি দরকার নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়ে। এভাবেই হয়ত ভাল আছি।
প্রার্থনা করি খুব চমৎকার হৃদয়বান একটি ছেলের সাথে যেন তোমার বিয়ে হয়। যার হাত ধরে র্নিভাবনায় বাকী জীবনটা তুমি কাটিয়ে দিতে পার-
চিঠি এখানেই শেষ। নাম ঠিকানা কিছুই নেই।
আশ্চর্য এ মুহুর্তে মিলি কিছুতেই লোকটার নাম মনে করতে পারছে না, কিন্তু কেন যেন জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

(আমাদের দেশের কোন এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার বন্ধ করে দেয়া উচিত, যেহেতু তারা দেশে না থেকে বিদেশে থাকে। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের দেশের অর্থনীতি দেশে পাঠানো প্রবাসীদের টাকার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শখ করে কেউ বিদেশে থাকতে চায় না, পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে। আমাদের ধারণা বিদেশে আমাদের দেশের লোকজনেরা সম্ভবত রাজার হালে আছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার কামাচ্ছে। কিন্তু দেশের জন্যে যখন তাদের মন আকুলি -বাকুলি করে তখন তাদের সেই কান্না আমরা দেখতে পাই না।

কবি জীবনান্দ দাসের সেই কবিতার লাইনটি আমার মাঝে মধ্যে মনে পড়ে-
হায় চিল সোনালী ডানার চিল
প্র্বাসীদের আমার কাছে সেই চিলের মতো মনে হয়, যার ডানা দুটি ভাঙ্গা। সীমাহীন আকাশ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সেই আকাশে ডানা মেলতে পারছে না।)

দেবদূত

বিশ্বের সবচেয়ে মতাশালী ব্যক্তি । একটি নির্জন খোলা মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন। উনাকে তাড়া করেছে কতগুলি ক্ষুদে দেবদূত। কোথায় যেন শুনেছিলেন ছোট বাচ্চারা মারা গেলে দেবদূত হয়ে যায়।
তিনি প্রাণপনে দৌড়াচ্ছেন তারপরও পিছনে তাকিয়ে দেখেন দেবদূতরা উনাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। এক সময় উনার দম ফুরিয়ে আসে। এবার দেবদূতরা উনাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। ধীরে ধীরে তারা বৃত্ত ছোট করে আনতে শুরু করে। উনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ভোর ৫.০১ মিনিট। লোকটি নিজেকে আবিস্কার করে নিজের বেডরুমের বিছানায়। এতক্ষণ তা হলে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। লোকটির মুখে ফোটে উঠে পরিতৃপ্তির হাসি।
পর মুহুর্তে বুকের মাঝখানে চিনচিনে এক ব্যথার অনুভূতি অনুভব করেন। এ অনুভূতি ধীরে ধীরে উনাকে গ্রাস করতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারছেন না স্বপ্নে দেখা ব্যথার অনুভূতি তো বাস্তবে অনুভব করার কথা না। এক সময় তিনি বুঝতে পারেন তিনি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। প্রচন্ড যন্ত্রণায় তার চোখ মুখ কুঁচকে আসে। কখনও তিনি ঈশ্বরকে ডাকার প্রয়োজন অনুভব করেননি। কারণ পৃথিবীর মানুষের ভাগ্য তিনি নির্ধারণ করেন ঈশ্বর নয়। তারপরও এক সময় ফিসফিস করে বলতে শুরু করেন- ঈশ্বর দয়া কর, দয়া করো করুণাময়।
এক সময় ব্যথা কমতে শুরু করে। তিনি স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। বাইরে ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। ভোরের আলো উনার জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছে।
তিনি জানালা খোলে দেন। একঝলক ঠান্ডা বাতাসে উনার শরীর কেঁপে উঠে। আজ কি চমৎকার লাগছে এই ভোরের আকাশ। বহুদূরে ইরাকের আকাশও কি এমনই সুন্দর, কখনও দেখা হয়নি। এমুহূর্তে কেন জানি ইচ্ছে করছে, সমস্ত যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে। এই সুন্দর পৃথিবীটা যেন সুন্দরই থাকে। যুদ্ধের নোংরা থাবা যেন এটাকে গ্রাস করতে না পারে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, জানেন এটা কোন অসম্ভব কাজ না। তারপরও উনার পক্ষে এটা করা সম্ভব না। এত কিছু দেখলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেদিন তিনি শপথ নেন, সেদিন অনেকগুলি শপথের সাথে মনে মনে আরও একটা শপথ নিয়েছিলেন। যে দিন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন সেদিন তিনি তার সম¯ত্ত আবেগ, মূল্যবোধ একটি বাক্সে তালা বন্ধ করে সেই তালার চাবি সাগরে ফেলে দেবেন। যেদিন মতা চলে যাবে সেদিনই শুধু তিনি ঐ চাবি খোঁজার চেষ্টা করবেন তার আগে নয়। চাবি পেলে ভাল, না পেলেও কোন সমস্যা নেই।
কিছুক্ষণ পরেই উনাকে নিতে হোয়াইট হাউজের গাড়ী আসছে। কারণ, আজ সংসদে খুব জরুরী একটা বিল পাস হবে ইরাকে আরও নতুন ২১৫০০ সৈন্য পাঠানোর ব্যপারে ।

(আমেরিকান রাষ্ট্রদূতদের নাক সম্ভবত খুব লম্বা, যার জন্যে তারা সুযোগ পেলেই আমাদের সব বিষয়ে নাক গলাতে পছন্দ করেন। প্রায়ই তারা বাঁকা মন্তব্য করে থাকেন, তোমরা বাঙালীরা কি বোকা। নিজেদের অর্থনীতির বারটা নিজেরাই বাজাচ্ছ। এক দিনের -হরতাল অবরোধে দেশের কোটি কোটি টাকার সর্বনাশ করছ। নিজেদের ভাল মন্দ বোঝার কোন মতাই তোমাদের নেই।
আমার মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে-
জনাব রাষ্ট্রদূত, আমরা বাঙালীরা সম্ভবত বোকা। শুধু বোকা নই, মহা বোকা। কিন্তু আপনারা কতো বড় বোকা, জর্জ বুশের মতো বদ্ধ উন্মাদ লোককে দুই বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেন। যে লোক শুধু মাত্র ইরাক যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অপচয় করছে। লক্ষ লক্ষ লোককে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
তারপরও ইরাকে আরও সৈন্য পাঠানোর জন্যে আপনারা সমর্থন দেন, যেখানে অন্য সব দেশ ইতিমধ্যেই সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে। আরও সৈন্য মানে আরও মৃত্যু, আরও ধ্বংস। আপনাদের বুদ্ধিমান ব্রেইনগুলি তখন কি কাজে ব্যস্ত থাকে।।
আমরা বোকা হলে, আপনারা গাধা,- শুধু গাধা নন, মহা গাধা।)

এক ফালি আকাশ

খোলা আকাশের নীচে মরিয়ম বিবি বসে চোখ মুছছেন । কোথায় যাবেন তিনি জানেন না। সামনে অপেক্ষা করে আছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
মাথার উপর এতদিন যে এক টুকরো ছাদের আশ্রয় ছিল আজ থেকে তা আর থাকছে না। উচ্ছেদ অভিযানের কারণে তাও চলে গেছে। বৈধ অবৈধ কি জিনিস তা তিনি খুব ভাল জানেন না। তিনি যা জানেন, তা হচ্ছে মাথার উপর এক টুকরো আশ্রয়, যেখানে তিনি তার সন্তান নিয়ে দিন কাটাতে পারেন।
ঠিক মতো এখনও ভোরের আলো ফোঁটতে শুরু করেনি। ভোর হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় উচ্ছেদ অভিযান। শীতের ঠান্ডা বাতাসে উনার বাচ্চারা কাঁপছে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে তিনি বাচ্চাদের শরীর ঢাকতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তিন বাচ্চার শরীর ঢাকার জন্যে উনার শাড়ীর আঁচল যথেষ্ট নয়।
সামনে বিশাল এক বহুতল ভবন মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক- দুই তলা করে তিনি গুণতে শুরু করেন। এক সময় ক্লান্ত হয়ে যান, গুণে শেষ করতে পারেন না। মরিয়ম বিবির খুব জানতে ইচ্ছে করে ঐ সব দালানে কারা থাকে। তারা কি তাদের মতোই সাধারণ মানুষ।
ছোট বেলায় মা খুব সুন্দর করে পরকালের গল্প করতেন। বুঝলি রে মরিয়ম, দুই দিনের এই দুনিয়ায় মানুষ আসছে কষ্ট করার জইন্যে। সব সুখ আল্লাহ পাক জমা রাখিছেন বেহেস্থে। যারা ভাল কাজ করিবে তারাই শুধু বেহেস্থে যাতি পারবে। সেইখানে খাওয়া পড়ার কোন চিন্তা নাই, খিদার কষ্ট নাই।
মরিয়ম বিবি চোখ বন্ধ করে বেহেস্থের সুখের কথা চিন্তা করার চেষ্টা করেন। তিনি কখনও বেহেস্থে প্রবেশ করতে পারবেন কিনা জানেন না। তিনি জীবনে তেমন কোন পূণ্যের কাজ করেননি। আবার কোন বড় পাপও তো করেননি। তাহলে উনার ভাগ্যের খাতা হচ্ছে শূন্য । এদের জন্যে পরকালে কি ব্যবস্থা রয়েছে।

বেহেস্থে নাকি মা সন্তান বলতে কোন কিছু নেই। উনাকে যদি শুধু একা স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়, তবে কি তিনি তার তিন সন্তানকে ফেলে স্বর্গে যাবেন। এক সময় উনার চিন্তা- ভাবনা ঘোলাটে হয়ে আসে।
এখন সবার আগে ইহ জগতের ক্ষুধার কষ্টই তীব্র ভাবে জানান দিচ্ছে। শুরু হতে যাচ্ছে অনাহারে থাকার এক ক্ষুধার্ত দিন। মাথার উপরে সৃষ্টিকর্তার এত বড় আকাশ, কিন্তু এ আকাশের উনার কোন দরকার নেই। উনার এখন দরকার মাথা গোঁজার এক টুকরো আশ্রয়, বাচ্চাদের জন্যে এক টুকরো রুটি।

(বর্তমান সরকারের উচ্ছেদ অভিযানে ভেঙে ফেলা হচ্ছে অবৈধ বাসস্থান। কিন্তু এর সাথে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে সমাজের নিম্নস্তরের অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ। এরা হচ্ছে ল্যাবটরির গিনিপিগের মতো। যখন যে ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন তা এদের উপর প্রয়োগ করা যায়। সমাজের কিছু অসৎ লোক সরকারী জমি নিজের নামে দখল করে সেই জমিতে তাদের অবৈধ ভাবে থাকার সুযোগ করে দিয়ে ভাড়া আদায় করছে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে ঐ সব নিরীহ লোকদের। বাকীরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
দেরীতে হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার উদ্যোগী হয়েছেন এদের পূর্নবাসনের ব্যপারে। দেখা যাক সরকারের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখতে পারে কিনা। কারণ, আমরা আমাদের সমস্যাগুলি সৃষ্টিকর্তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পছন্দ করি। আমাদের ধারণা উনি স্বয়ং এসে এর সমাধান করে দিয়ে যাবেন।)

দুঃস্বপ্নের রাত

সমস্যা কার?
আমার স্ত্রীর।
তিনি কোথায়?
তাকে বাসায় রেখে এসেছি।
মনো চিকিৎসকদের আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। আজ নিতান্ত ঠেকায় পড়ে এখানে আসতে হয়েছে।
সমস্যা যেহেতু আপনার স্ত্রীর, তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত। আপনি যেহেতু এসেছেন, সব কিছু ডিটেইলস বর্ণনা করবেন। কোন খুঁটিনাটি বাদ দেবেন না। অনেক সময় দেখা যায় অনেক অপ্রোয়জনীয় বর্ণনাও অনেক কাজে আসে।
টুকন ছিল আমাদের একমাত্র মেয়ে, বয়স মাত্র তিন বছর।
ছিল মানে?
দুই মাস আগে মারা গেছে। আমাদের বাড়ির পেছনে ছোট একটা ডোবা আছে, তাতে ডুবে মরেছে। সমস্যার শুরু মূলত তার পর থেকেই। আমার স্ত্রীর ধারনা, তার মেয়ে মরেনি, যে কোন সময় ফিরে আসবে।
হয়ত রাতে ঘুমিয়ে আছি, আমার স্ত্রী হঠাৎ করে মাঝরাতে ডেকে তুলে বলবে, অ্যাই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, টুকন বাইরে বৃষ্টিতে ভিজছে। মেয়েটা ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারে না। চলো এক্ষুণি গিয়ে তাকে নিয়ে আসি।
টুকনকে আমাদের বাড়ীর পেছনেই কবর দেয়া হয়ে ছিল। সারা রাত আমাকে আর ঘুমুতে দেবে না, এ যন্ত্রনা চলতেই থাকবে।
প্রথম প্রথম মনে করে ছিলাম এ সমস্যা সাময়িক, সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সমস্যা আরও বাড়ছে।
আমার সামনে বসা ডাক্তার এতক্ষণ খুব মন দিয়ে আমার প্রতিটা কথা শুনছিলেন।
এবার মুখ খোলেন-আচ্ছা, আপনি বলছেন আপনার স্ত্রীর ধারণা, তার মেয়ে মরেনি। মেয়েটা যেহেতু আপনাদের দু'জনের, তাই আমাদের মেয়ে না বলে আমার স্ত্রীর মেয়ে কেন বলছেন?
আপনাকে আসলে বলা হয়নি- এক রোড এক্সিডেন্টে টুকনের বাবা মারা গেলে তার মার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে।
আই সি, আপনি আপনার বর্ণনায় বলেছেন, টুকন পানিতে ডুবে মরেছে- এমন ভাবে কেন বলছেন। এতটুকু একটা বাচ্চা মাত্র দু'মাস আগে যার মৃত্যু হয়েছে, এত বড় একটা ঘটনার বর্ণনা আপনি খুব সহজ ভাবে দিচ্ছেন । আপনাকে সামান্যতম আবেগপ্রবণও মনে হয়নি। কেন? আমার ধারণা, অবশ্য ঠিক না-ও হতে পারে।
আমি কিছুণ চুপ করে থাকি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেই সত্য কথাটাই বলব। এ ছাড়া এখন কোন উপায়ও নেই।
টুকনের মার সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন টুকন ছিল তার গর্ভে। সবকিছু জেনেই আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম। কারণ, আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। তখন আমি তাকে পৃথিবীর যে কোন কিছুর বিনিময়ে পেতে রাজী আছি। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল। ঝামেলা শুরু হয় মূলত টুকনের জন্মের পর থেকে।
আমার স্ত্রী হঠাৎ করে বদলে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তার সবটুকু অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই টুকন। প্রতিটি মুহূর্তে সে টুকনকে নিয়েই ব্যস্ত। তার চারপাশে যেন আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমার স্ত্রীর প্রতি আমার এত দিনের জমানো ভালোবাসা এক সময় আমার কাছে অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে। আমি টুকনের প্রতি এক ধরণের ঈর্ষা অনুভব করতে থাকি। এই ঈর্ষার উৎস কোথায় আমি জানি না।
যে দিন টুকন মারা যায়, সেদিন আমি আমাদের বাসার ছাদে দাঁড়ানো ছিলাম। ছোট্র বাচ্চা খেলতে খেলতে এক সময় ডোবার কাছে চলে যায়। তারপর পা পিছলে ডোবায় পড়ে যায়। আমি ইচ্ছে করলে তক্ষুনি দৌঁড়ে গিয়ে হয়তো তাকে বাঁচাতে পারতাম, কিন্তু তখন মাথায় ভূত চেপে গেছে। আমার তখন শুধুই মনে হচ্ছিল যত নষ্টের গোঁড়া হচ্ছে এই বাচ্চাটা। আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে। আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার উপর।
আমার চোখের সামনেই টুকন ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। ডাক্তার, আপনি হয়ত এর জন্যে আমাকেই দায়ী করবেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন এর জন্যে আমি দায়ী নই, আমার অন্ধ ভালোবাসাই দায়ী।
আপনার স্ত্রীর সমস্যা কি তার পর থেকেই শুরু হয়?- ডাক্তার গম্ভীর গলায় একেকটা শব্দ উচ্চারণ করেন।
উত্তর দিতে আমি এক মুহূর্ত চিন্তা করি। তারপর ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করি এতদিন আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে আসলে আমার নিজেকে নিয়ে। আমার স্ত্রীর মতো এখন আমিও টুকনকে দেখতে শুরু করেছি। হয়ত রাতে আমি আমার বেডরুমে শুয়ে আছি, হঠাৎ করে আমার মনে হবে টুকন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সারা রাত ঘুমাতে পারি না। রাতের পর রাত জেগে বসে থাকি।
এখন অবস্থা এমন হয়েছে, আমার স্ত্রী ধীরে ধীরে টুকনকে ভুলতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্যেও টুকনকে ভুলতে পারছি না। প্রতিটি মুহূর্ত টুকনের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফেরে।
প্লিজ ডাক্তার আপনি আমাকে এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বাঁচান।


(কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী (আমি নাম বলতে চাচ্ছি না) আছেন যারা প্রায় সময়ই দৈহিক ভালোবাসার কথা বলে থাকেন, এ ছাড়া নাকি ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। এটাকে আমার কাছে একটা নোংরা ব্যাপার বলে মনে হয়। মাফ করবেন, কারো ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ভালোবাসায় দৈহিক আকর্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু এটা না থাকলে ভালোবাসাও থাকবে না, এ কেমন কথা। দাম্পত্য জীবনে একসময় বার্ধক্য আসবে, কমে যাবে দৈহিক আকর্ষণ, তাহলে কি তখন আর ভালোবাসা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না।
দেহ এক সময় নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ভালোবাসা কি কখনও নষ্ট হয়। এ জন্যেই হয়ত বলা হয় মানুষ মরে যায় কিন্তু বেঁচে থাকে তার ভালোবাসা।
সত্যিকারের ভালোবাসা হওয়া উচিত এমন যার জন্যে অপেক্ষা করা যায় অনন্তকাল ধরে।
ভালোবাসা সম্ভবত একেক জনের কাছে একেক রকম। একজন দেশ প্রেমিক বলবে আমার ভালোবাসা হচ্ছে আমার মাতৃভূমি। মার কাছে ভালোবাসা তার সন্তান। শিক্ষকের কাছে তার ছাত্র। এটাইতো সত্যিকারের ভালোবাসা।)

জ্যোতিষী

শ্রী অলোকনাথ চক্রবর্তী (ত্রিকালদর্শী)
ভূত (অতীত) - বর্তমান - ভবিষ্যত : বিশেষজ্ঞ
(হস্থরেখা বিশারদ)

পঞ্চাশ উর্ধ্ব অলোকনাথ পূর্বপুরুষের জ্যোতিষী বিদ্যাটাকে পরম যত্নে ধরে রেখেছেন। যদি প্রশ্ন করা হয়-এই বিদ্যা কতটুকু বিঞ্জানসম্মত তবে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর করেন-হে বৎস বিশ্বাসে ঈশ্বর মেলে তর্কেতে তা বহুদূর। তিনি এই শ্রাস্ত্র মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কারণ উনার পূর্বপুরুষদের এত দিনের বিশ্বাস মিথ্যে হতে পারে না।
অনেক ধারনের লোক উনার কাছে হাত দেখাতে আসে, উনি পুরনো নথি পত্র ঘেটে তাদের হস্থ রেখা বিচার করেন। কারো কারো ক্ষেত্রে উনার ভবিষ্যতবাণী আশ্চর্য রকম ভাবে ফলে যায়, কারো কারো ক্ষেত্রে তা ভূয়া প্রমাণিত হয়। এ ক্ষেত্রে উনার ব্যাখা হচ্ছে গ্রহ- নত্রের প্রভাবে মানুষের ভাগ্য রেখা পরিবর্তিত হতে পারে, এতে উনার কোন দোষ নেই। অনেকে উনার এই যুক্তি বিশ্বাস করে অনেকে মুখ টিপে হাসে।
চিরকুমার অলোকনাথ বিয়ে থা করেননি, একলা মানুষ কোন ঝুট ঝামেলা নেই। হাত দেখে আর পূজা পাঠ করে উনার দিন কেটে যায়।
একদিন উনার ভক্তদের নিয়ে বারান্দায় বসে তিনি আলোচনায় মগ্ন। হঠাৎ করে এক ভক্ত মুথ ফস্কে বলে বসে-অলোক বাবু আপনি হাত দেখে মানুষের জন্ম -মৃত্যু বলে দিতে পারেন, কখনও কি নিজের হাত দেখেছেন? এক মুহূর্তের জন্যে অলোকনাথ থমকে যান, এ কথাটা উনার কখনও মনে হয়নি।
তিনি এড়িয়ে যেতে চান কিন্তু ভক্তরা উনাকে চেপে ধরে। অগত্য অলোকনাথ ব্যাগ থেকে পুরনো আঁতশী কাঁচটা বের করে বসে পড়েন নিজের হস্থ রেখা বিচার করতে। অনেকণ ধরে পরীক্ষা করে তিনি চমকে উঠেন, উনার মৃত্যু ৬১ বছর বয়সে - চৈত্র মাসের কোন এক আমবস্যার রাতে। বিড়বিড় করে কথাকটি উচ্চারণ করে তিনি উঠে বাসার ভেতরে চলে যান।
মাঝে বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। অলোক বাবুর বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। কিন্তু এখনও তিনি আগের মতই কর্মম আছেন। এখনও মাঝে মাঝে ভক্তদের নিয়ে তিনি বসেন। মাঝে মাঝে ভক্তরা ঠাট্টা করে বলে-’কি হে অলোক বাবু আর তো মাত্র এক বছর আমরা আপনাকে আমাদের মাঝে পাচ্ছি , তারপর তো আপনি ইহলোকের মায়া ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করছেন। অলোক বাবু কিছু বলেন না।
এক বছর পেরিয়ে গেছে। অলোকনাথ বয়স এখন ৬১।
আজ ১৪ চৈত্র-পঞ্জিকা মতে আজ ঘোর আমবস্যা। আজ সারাদিন অলোকনাথ মুখে কিছু দিতে পারেননি, সন্ধ্যার পর থেকে তিনি অস্থিরতায় ভূগতে শুরু করেন। আজ কি তবে তার মৃত্যু নিশ্চিত, নাকি আজ তার পূর্ব পুরুষের এত দিনের শাস্ত্র মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। উনার পূর্ব পুরুষেরা প্রায় সবাই শতবর্ষী ছিলেন।
রাত্র যত গভীর হতে শুরু করে, উনার বুকের ধুক-পুকানি ততই বাড়তে শুরু করে। বিরাট পাথরের বোঝা যেন উনার বুকের উপর চেপে বসে। নিজের মনেই তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন না-না আমার এত দিনের বিশ্বাস মিথ্যে হতে পারে না । তবে যে আমি সবার কাছে একজন মিথ্যা জ্যোতিষী বলে প্রমাণিত হব। সবাই আমাকে নিয়ে হাসা-হাসি করবে। বলবে, ঐ দেখ এক জোচ্চর জ্যোতিষী , তার পূর্বপুরুষেরাও নিশ্চয়ই তার মতই জোচ্চর ছিল। এ অপমানের বোঝা তিনি কিভাবে বহন করবেন।
অলোকনাথ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন- উনাকে কি করতে হবে, তার কারণে তার পূর্বপুরুষের সন্মান তিনি এভাবে ধুলায় লুটাতে দেবেন না। এক সময় উনার বুকটা হালকা হয়ে আসে।
পরদিন সবাই অলোকনাথের ঝুলন্ত দেহ আবিস্কার করে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগানো অবস্থায়। ভক্তদের মাঝে গুঞ্জন উঠে -শেষ পর্যন্ত তাহলে অলোক বাবুর ভবিষ্যত বাণীই সত্য প্রমাণিত হল। কারণ, মৃত্যুর দিন ক্ষণ তিনি ঠিক ঠিক ভাবে বলে গেছেন, কিন্তু কিভাবে মৃত্যু হবে তা আর বলেননি।
অলোকনাথ চক্রবর্তী নেই কিন্তু উনার বাড়ীর সামনের রং ওঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাইনবোর্ড খানা আজও আছে, শুধু এতে দুইটা নতুন লাইন ভক্তরা যুক্ত করেছে-


শ্রী অলোকনাথ চক্রবর্তী (ত্রিকালদর্শী)
ভূত (অতীত) - বর্তমান - ভবিষ্যত : বিশেষজ্ঞ
(হস্থরেখা বিশারদ)
উপমহাদেশের সেরা জ্যোতিষী (উনার মৃত্যুই এর জ্বলন্ত প্রমাণ)
ইহলোকের মায়া ত্যাগ: ১৪ চৈত্র আমবস্যা রাতে (মাত্র ৬১ বছর বয়সে)



(খুব কম লোকই পাওয়া যাবে যিনি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে সেইদিনের নিজের রাশি ফলটা না দেখেন। সবাই যে এই জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন এমন না। কিন্তু তারপরও মনের মাঝে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে। যেদিন লেখা থাকে আজ আপনার দিনটি শুভ যাবে, সেদিন অজান্তেই মনের মাঝে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে। আবার যেদিন লেখা থাকে আজ আপনার দিনটি খারাপ যাবে সেদিন মনটাই খারাপ হয়ে যায়। তবে আমি মনে করি একজন মানুষের জীবনে ভাগ্যের হয়ত কিছুটা ভূমিকা আছে, কিন্তু মানুষ তার ভাগ্য নিজেই পরিবর্তন করতে পারে। এর জন্যে তাকে কোন জ্যেতিষীর শরণাপন্ন হওয়ার কোন দরকার নেই।)

আর্টিস্ট

তিন্নির সাথে আমার প্রথম দেখা এক আর্ট এক্সিবিশনে। চারুকলার ছাত্রী তিন্নি। আর্টের প্রতি তার দারুণ আগ্রহ।
আমার আঁকা একটি মেয়ের ছবির সামনে তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। রক্তে সমস্ত ক্যানভাস ভেসে যাচ্ছে। ওহ মাগো, কি জীবন্ত ছবি-তিন্নি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।
জীবন্ত ছবি আঁকা শিখতে চাও-তিন্নির হাতে আমি আমার ঠিকানা লেখা একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।
এর কয়েক দিন পর তিন্নি আমার বাসায় এসে হাজির। মেধাবী ছাত্রী তিন্নি, খুব দ্রুত শিখতে শুরু করে। তিন্নির চোখে আমি একজন খুব বড় মাপের শিল্পি এবং নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের মানুষ।
আজ বিশেষ একটি দিন। আমি এবং তিন্নি মিলে একটি জীবন্ত ছবির স্কেচ করব।
একেবারে ঠিক সময়ে তিন্নি এসে হাজির, উৎসাহে তার চোখ মুখ ঝলমল করছে। কি জীবন্ত একটি মুখ, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পরমুহূর্তে তিন্নির মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে শুরু করে, দুই চোখে সীমাহীন আতংক এসে ভর করে। আমার হাতে রং-তুলির বদলে চকচকে একটি ক্ষুর। আমি তিন্নির দিকে এগুতে শুরু করি। তিন্নি ক্রমশ পেছাতে থাকে। এক সময় তিন্নির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। আমার দুই চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠে।
তিন্নি আমি ভয়ানক অসুস্থ একজন মানুষ। নরকের কোন এক অন্ধকার জগতে আমার জন্ম। আমার ভেতরের পশুটা আমার চেয়েও শক্তিশালী । আমার ভেতরের পশুটা বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছে, আমি তাকে থামাতে পারছি না। আমাকে মা কর তিন্নি।
রক্তে তিন্নির সমস্ত মুখ ভেসে যাচ্ছে। আমি সেই রক্তে ব্রাশ ডুবিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করি।
এর কয়েকদিন পর।
আমার এক আর্ট এক্সিবিশনে আমার এক ছবির সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইস, কি ভয়ানক আর জীবন্ত ছবি-মেয়েটির চোখে বিস্ময়।
আমি এগিয়ে যাই। মেয়েটি ঠিকই বলেছে, কারণ এটাই তিন্নির আঁকা আমার শেষ ছবি।
এরকম ছবি আঁকা শিখতে চাও?-আমি মেয়েটির দিকে আমার ঠিকানা লেখা কার্ডটি বাড়িয়ে ধরি।


(উসর্গ: শিল্পি ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
আপনি যদি আমাদের দেশের কোন তারকাকে তার কোন প্রিয় শিল্পির নাম বলতে বলেন, তবে তিনি চোখ মুখ নাচিয়ে বলবেন- কেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
শিল্পি জয়নাল আবেদিন বা কামরুল হাসানের নাম তারা বলবেন না।
মাফ করবেন, কারো ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যপারে আমার কোন মতামত নেই।
কিন্তু এর পরপরই সেই তারকা আপনাকে উল্টো প্রশ্ন করবেন-আপনি কি জানেন ভিনসেন্ট কেন বিখ্যাত? তিনি ভালবাসার নিদর্শনস্বরুপ তার প্রেমিকাকে কান কেটে সেই কান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বুঝুন অবস্থা। ভিনসেন্ট যত না তার ছবির জন্যে বিখ্যাত তারচেয়ে বেশী বিখ্যাত কান কাটার জন্যে।
এই কান্ডটা যদি আমি করতাম তবে নির্ঘাত পরদিনই পত্রিকায় আসত এক উন্মাদের কান্ড- শিরোনামে। কিন্তু যেহেতু কান্ডটি ভিনসেন্ট করেছেন তাই এটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে।
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত কিন্তু আমার মতে নিশ্চয়ই এভাবে নয়।
ভ্যান গগের প্রেমিকা (যিনি ছিলেন একজন পতিতা) ছিলেন এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। তাকে শেষ পর্যন্ত আলোর জগতে নিয়ে আসার কোন চেষ্টা ভিনসেন্ট করে ছিলেন কিনা আমার জানা নেই।
বড় মাপের শিল্পিরা বাস্তব জীবনেও বড় মাপের মানুষ হবেন বলে আমরা ধরে নেই। ঈশ্বর সম্ভবত সবাইকে সব মতা দান করেন না। কিন্তু যাদের ঈশ্বর প্রদত্ত সেই মতা আছে তাদের সেই মতা নষ্ট করা উচিত না।)

হিউম্যান বম্ব

অবর্ণনীয় কষ্টে মামুনের সমস্ত শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে।
অবশ্য শরীর বলতে এখন আর তেমন বেশী কিছূ অবশিষ্ট নেই, বোমার অঘাতে কোমরের নীচের অংশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে।
মামুন তার আবছা আবছা চেতনায় বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে, স্বর্গে তো কোন কষ্ট থাকার কথা নয়। তার মানে এখন সে রয়েছে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি।
ডাক্তার নার্সরা মিলে প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে মামুনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে। মামুনের খুব ঘুম পাচ্ছে, সে যদি একবার ঘুমিয়ে পড়তে পারে তাহলে সেই ঘুম আর ভাঙবে না। কিন্তু এরা তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না।
বাবা তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? -দূর থেকে মার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। মামুন বুঝতে পারছে না মা এখানে কিভাবে এল। সে তো বাড়ীতে কাউকে বলে আসেনি।
উনিশ বছরের এক উচ্ছল যুবক মামুন। অভাবের সংসারে হাইস্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি। বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করে সময় কাটত। হঠাৎ করে গ্রামে কিছু রহস্যময় লোকের আগমন ঘটে। আরও রহস্যময় তাদের কথাবার্তা আচরণ। মামুনের এতদিনের চেনা জগৎটা হঠাৎ করে বদলে যেতে শুরু করে । চোখের সামনে এক অচেনা জগতের হাতছানি। মামুনের তরুণ রক্তে বইছে নতুন কিছু করার ইচ্ছা, সে সহজেই এই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রথম প্রথম চলে ধর্মীয় পুস্তকের আলোচনা, ভিডিও প্রশিক্ষন- জিহাদী সব বক্তৃতায় রক্ত গরম হয়ে উঠত। সবশেষে বোমায় হাতেখড়ি ।
তারপর আসে সেই দিন যেদিন মামুন নিজেই একটি হিউম্যান বম্বে পরিণত হয়।
দল নেতা একদিন মামুনের কাঁধে হাত রাখেন-আগামীকাল তুমি এক নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছ। মিশন সাফল্যের সাথে শেষ করতে পারলে তোমার এই আতœত্যাগ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তুমি পাবে শহীদের মর্যাদা, বেহেসস্তর দরজা তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
পরাদিন কাউকে কিছু না বলে মামুন বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। মামুন ছেলে বেলায় ৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের কথা শুনে ছিল। ঐ সময় ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে ছিল, কিন্তু তা ছিল দেশের শত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধ কাদের বিরুদ্ধে মামুনের ক্ষুদ্র মস্তিস্ক ধরতে পারে না।
মামুনের শরীরে বাঁধা বোমার আঘাতে কত লোক মারা গেছে মামুন তা জানে না। তাদের কি আপরাধে মরতে হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন নিরীহ লোক, কতজন বাচ্চা রয়েছে মামুন তাও জানে না।
খোকা ও খোকা-মা আকুল হয়ে ডাকছে।
হঠাৎ করে ডাক্তারের মুখটা বাবার ভাঙাচোরা চেহারা বলে মনে হয়। মামুন বুঝতে পারছে এসব তার অবচেতন মনের কল্পনা, বাস্তবে আসলে এসব ঘটছে না। কিন্তু বাস্তবে হলে খুব ভাল হত। পরিবারের লোকজন তাকে ঘিরে থাকত আর সে তার মায়ের কোলে মাথা রেথে নিশ্চিন্ত মরতে পারত। সে তো একজন শহীদের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে, তারপরও কেন তার বুক চিরে কান্না উথলে উঠছে। একদিকে স্বর্গের অনন্ত সুখ, অপর দিকে কষ্টের এই পৃথিবী।
মামুন বিড়বিড় করে বলতে থাকে-মা, আমি ক্ষমার অযোগ্য আপরাধ করেছি, মৃত্যুপথযাত্রী তোমার এই ছেলেকে ক্ষমা কর মা। পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে আমি আবার তোমার ছেলে হয়ে জন্ম নিতে চাই, একবার না বারবার।
মামুনের মন চলে যায় তার শৈশবে। রাতের বেলা মায়ের কাছে রুপকথা শুনা, বাবার হাত ধরে গ্রামের পথে হেঁটে চলা, ছোট বোনের সাথে দূষ্টুমির সেই ক্ষণ।
ঈশ্বর- মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা নাকি পূরণ হয়। আমার মৃত্যু আসন্ন, মৃত্যুর পর আমার স্থান কোথায় হবে, আমি জানি না। আমি যে ভুল করেছি তার কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই, তারপরও যাদি বেঁচে থাকি তবে শুধু একটি মুহূর্তের জন্যে ফিরিয়ে দিও আমার সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশব, শুধু মাত্র একটি মুহূর্তের জন্যে-ধীরে ধীরে মামুনের কন্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। হাসপাতালের বেডের পাশে রাখা মনিটরে মামুনের লাইফ লাইন ও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে।



(বিভিন্ন আত্নঘাতী বোমা হামলাকারীদের ধরা পড়ার খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পাচ্ছি। কিন্ত এদেরকে শুধু ঐ কাজের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আসল আপরাধীরা এখনও রয়ে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরে।

এর পেছনে যারা রয়েছে তারা কি এক সময় শাস্তি পাবে, আত্নঘাতী বোমা হামলা কি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হবে, আমরা জানি না।

হয়ত আবার কিছুদিন পর অশূভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু জঙ্গীবাদের শিকার মামুন নামের সেইসব আত্নযাতী হামলাকারীরা আর সেই হামলার শিকার সেইসব নিরীহ লোকজন আর কখনও ফিরে আসবে না। )

পলিটিক্স

স্বর্গের দারোয়ান খুব হই চই শুরু করে দিল।
একজন লোক বিনা অনুমতিতে স্বর্গে প্রবেশ করতে চাচ্ছে।
দারোয়ান তাকে কিছুতেই ঢুকতে দিবে না।
সেই লোকও নাছোড়বান্দা।
অবশেষে দারোয়ান তাকে স্বর্গের দেবদূতের কাছে নিয়ে গেল।
দেবদূতকে দেখেই লোকটা হড়বড় করে বলতে শুরু করে দিল, মিস্টার দেখুন, আমি বুঝতে পারছি না, আমাকে কেন স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। আমি একজন সন্মানিত লোক, স্বর্গই আমার উপযুক্ত স্থান হওয়া উচিত।
দেবদূত কিচুণ ভ্র“ কুচকে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, কিন্তু আমি যতদূর জানি, তোমাকে তো নরকে প্রবেশের টিকেট দেয়া হয়েছে। এই টিকেটে তো তুমি স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনাদের সফটওয়্যারে কোন ঘাপলা হয়েছে। না হলে এই ধরনের ভুল হতে পারে না।
দেবদুত অবাক হয়ে জিঞ্জাসা করলেন, সফটওয়্যার? সেটা আবার কি জিনিস?
এবার অবাক হওয়ার পালা ওই ব্যক্তির। তারমানে বলতে চাচ্ছেন, আপনাদের স্বর্গে কোন কম্পিউটার নেই। তাহলে আপনারা আপনাদের হিসেব পত্র কিভাবে করেন।
দেবদূত বিরক্ত গলায় বললেন, কি যা তা বলছো। তোমাদের ধর্মগ্রন্থে কি স্বর্গের বর্ণনা দেয়া নেই, সেখানে কি কম্পিউটারের কথা লেখা আছে?
লোকটা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বলে, না সেটা বলছি না। কিন্তু ধর্মগ্রন্থে যে স্বর্গের বর্ণনা দেয়া আছে তা তো হাজার বছরের পুরনো স্বর্গ। এরমধ্যে পৃথিবী এত এগিয়ে গেছে, স্বর্গেও নিশ্চয়ই ব্যাপক পরিবর্তন যটেছে।
গাধার মতো কথা বলো না। দেবদূত ধমকে ওঠেন। তুমি কি কখনও সূর্যকে পশ্চিম দিকে উঠতে দেখেছ, মাছ কে আকাশে উড়তে অথবা পাখিকে নদীতে সাতার কাটতে। এটা এমনই একটা সিস্টেম যা কখনই ক্রাশ করে না। তাহলে কোন যুক্তিতে ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা পরিবর্তিত হবে।
ঠিক আছে, আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আমার ফাইলটা পুনরায় রি-ওপেন করে দেখা হোক।
দেবদূত লোকটাকে হিসাবরক্ষণ অফিসারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

অফিসার ফাইলপত্র যেটেযুটে লোকটার ফাইলটা খুজে বের করেন। ফাইল উল্টিয়ে
অফিসার চেঁচিয়ে ওঠেন, সর্বনাশ! ফাইলে দেখা যাচ্ছে, জীবিত অবস্থায় তুমি একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলে, তাও তৃতীয় বিশ্বের দূর্নীতিগ্রস্থ একটি দেশের। তাহলে তুমি এমন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে নিজেকে কিভাবে সৎ এবং আদর্শবান লোক হিসেবে দাবি করছ। তোমার জন্যে তো নরকই উপযুক্ত স্থান। সেখানে খোঁজ করলে তুমি তোমার অনেক বন্ধু-বান্ধবও পেয়ে যেতে পার।
লোকটা এবার মরিয়া হয়ে ফাইলের কিছু পেপার কাটিংয়ের দিকে অফিসারের দৃষ্টি আকষণ করে বলে ওঠে, তাহলে এগুলো কি? এ ছবিগুলিই প্রমাণ করে, আমার সময় দেশের লোকজন কত সুখে ছিল। এখানে সবগুলিই হাসি-খুশি লোকজনের ছবি। আমার একেকটি সভায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। আমি অসৎ ব্যক্তি হয়ে থাকলে এটা কিভাবে সম্ভব?
হিসাবরণ অফিসার কিছুণ চিন্তা করে বলেন, বুঝতে পারছি না তোমাকে নিয়ে আসলে কি করা উচিত। তোমার রিপোর্টের সঙ্গে তোমার কথাবার্তার কোন মিল নেই। বেশ জটিল কেস। সবচেয়ে ভাল হয়, তুমি ঈশ্বরের সাথে কথা বল।
ঠিক আছে, সেই ভাল, লোকটা উৎসাহিত হয়ে উঠে ঈশ্বরকে কখন পাওয়া যাবে?
এখানে সময় বলতে কোন জিনিস নেই। হিসাবরণ অফিসারের ঠোট উল্টিয়ে বলে ওঠেন।
তাহলে আপনাদের এখানে আইনস্টাইন-এর টাইম অফ রিয়েলিটির সূত্র কাজ করছে।
ঐটা আবার কি জিনিস? অফিসার জানতে চান।
আইনস্টাইন হচ্ছেন অনেক বড় একজন বিঞ্জানী। এটা তার বিখ্যাত একটি সূত্র। আচ্ছা তার তো আপনাদের এখানেই থাকার কথা।

হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি। অফিসার বলে ওঠেন। কিন্তু তার মামলা তো এখনও বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।
কি বলছেন, এতো মহৎ একজন বিঞ্জানী! তিনি এখনও স্বর্গে যাননি!
আমি ঠিক জানি না। তুমি এ ব্যাপারে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারো।
অবশেষে এক সময় ওই লোক ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়। বিনীতভাবে জানতে চায়, ঈশ্বর,
প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি আইনস্টাইনকে কেন এখনও স্বর্গে পাঠানো হচ্ছে না। তিনি মানুষের উপকারের জন্যে কত বড় বড় আবিস্কার করেছেন। মানুষের সেবাইতো সবচেয়ে বড় ইবাদত, তাই নয় কি!
ইশ্বর গম্ভীর স্বরে বললেন, তোমার এই বিঞ্জানী আনবিক শক্তি নামের একটি ভয়াবহ জিনিসও আবিস্কার করেছে। একেকটা আণবিক বোমা যখন একেকটা শহরকে গুড়িয়ে দেয়, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়ায় তখন তুমি এর জন্যে কাকে দায়ী করবে? যতোদিন তোমরা আণবিক বোমা তৈলী বন্ধ না করবে ততোদিন পর্যন্ত তো তোমাদের আইনস্টাইন স্বর্গে যেতে পারছে না।
কিন্তু ঈশ্বর, এর জন্যে তো আমরা মানুষরাই দায়ী। আইনস্টাইন তো নিশ্চয়ই মানুষ মারার জন্যে আণবিক বোমা তৈরী করা হবে এ কথা আগে থেকে জানতেন না।
ঈশ্বর মৃদু হেসে বললেন, তোমার কথা আংশিক ঠিক। তোমাদের আইনস্টাইন ভালভাবেই জানতো তার এই আবিস্কার কি কাজে ব্যবহার করা হবে। তবে এটা ঠিক, এর মতা যে এত ভয়াবহ হবে এটা বোধহয় সেও জানত না। ঠিক আছে, তোমার যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়েছি। এতো দিনে নিশ্চয়ই তোমাদের বিঞ্জানীর স্বর্গে যাওয়ার সময় হয়েছে। তাকে স্বর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
ধন্যবাদ ইশ্বর। এবার আমার কেসটা একটু দেখবেন।
তুমি তোমার দেশের জনগণকে সুখে রেখেছিলে এটা কি প্রমাণ করতে পারবে?
অবশ্যই পারব।
এই দেখুন। বলে লোকটা পকেট থেকে অনেকগুলি রঙ-বেরঙ এর চশমা বের করে।
লোকটা একটা চশমা এগিয়ে দেয় ঈশ্বরের দিকে। আমার দেশের চারদিকে যখন অন্যায়-অত্যাচার বেড়ে যেতো তখন আমার দেশের জনগণকে এই চশমা পরতে বলতাম।
চশমা চোখে দিয়ে ঈশ্বর অবাক হয়ে বলেন, আশ্চর্য! তোমার চশম্ দিয়ে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

মজা তো এখানেই, লোকটা উৎসাহিত হয়ে বলে।
আপনি এই চশমা পরলে আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায়-অত্যাচার কিছুই দেখতে পাবেন না। আবার আমার দেশের জনগণ যখন কষ্টে থাকতো তাদের এই ভার্চুয়াল চশমা পরতে বলতাম। এই চশমা পরলে আপনার সামনে একটি কল্পনার জগৎ তৈরি হবে। এখানে আপনি যা দেখতে চান তা-ই দেখতে পারবেন। দুঃখ-কষ্ট আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
ঈশ্বর মৃদু হাসলেন।
তোমার চমৎকার আইডিয়াতে মুগ্ধ হয়ে এক্ষুণি তোমাকে স্বর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু এখানে ছোট্র একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বর্গে যাওয়ার শেষ গাড়িটা একটু আগেই ছেড়ে গেছে। গাড়িতে একটা সিটই খালি ছিল। তোমার কথামতো ওই সিটে তোমাদের বিঞ্জানীকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমাকে পরবর্তী গাড়ির জন্যে অপক্ষা করতে হচ্ছে।
কোন সমস্যা নেই। তা আপনাদের পরবর্তী গাড়ি কয়টা সময় ছেড়ে যাবে। লোকটা হাত নেড়ে জানতে চায়।
আজ থেকে ঠিক এক হাজার বছর পর। ঈশ্বর নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেন। ততোদিন পর্যন্ত তোমাকে নরকেই কাটাতে হচ্ছে। আমার মনে হয় তোমার কোন সমস্যা হবে না। কারণ তোমার কাছে তোমার ভার্চুয়াল চশমা তো রয়েছেই। এটা দিয়েই তুমি নরকে বসে দিব্যি স্বর্গ দেখতে পাবে।

টিপস

নরকের দেবদূতরা খুব সমস্যায় আছেন, নিত্য নতুন শাস্তির ব্যবস্থা করতে করতে তাদের আইডিয়া বক্স খালি হয়ে গেছে। কত আর পারা যায়। যে ভাবে নরকের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে কিছু দিন পর অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
মানুষ খুব বিচিত্র প্রাণী। একই ধরনের শাস্তি একজনকে বার বার দেয়া হলে পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে সে ঐ শাস্তিতে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে। যতটুকু কষ্ট তার পাওয়া উচিত ততটুকু কষ্ট সে আর পাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ঈশ্বরের কাছে শেষ পর্যন্ত মুখ দেখানোই মুসকিল হয়ে পড়বে।
নরকের প্রধান দেবদূত গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। গুড মর্নিং- বলে নরকের এক বাসিন্দা এগিয়ে আসে। জনাব, আমি কি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি
প্রধান দেবদূত মুখ তোলে লোকটাকে পর্যবেণ করে খেঁকিয়ে উঠেন-কি চাই?
আমি আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি, আপনি যদি আমার সাথে একটা চুক্তিতে আসেন তবে আমি আপনাদের সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি।
দেবদূত প্রধান অবাক হন, তুমি কে? আর আমার সমস্যা সম্পর্কেই বা তুমি জানলে কি ভাবে?
অন্যের সমস্যায় নাক গলানোই আমার কাজ। আপনার শিস্যদের কাছ থেকে আমি আপনার সমস্যা সম্পর্কে জেনেছি।
তোমার পরিচয়?
আমি ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে মতাশালী একটা দেশের প্রেসিডেন্ট, আমার নাম...
ব্যস ব্যস আর বলতে হবে না- দেবদূত হাত উঠিয়ে লোকটাকে থামিয়ে দেন। এবার আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি, এ কারণেই তোমার চেহারাটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। তোমার মতো কুচক্রি বুদ্ধির লোক আমরা আর দ্বিতীয়টা পাইনি। সত্রাস দমন, গণতত্র প্রতিষ্ঠার নাম করে তুমি অনেক দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছ। বৃদ্ধ-মহিলা এমন কি শিশুদের কেও তুমি রেহাই দাওনি। এক ফোঁটা তেলের জন্যে তুমি হাজার ফোঁটা রক্ত ঝরিয়েছ। তোমার কাজের ফিরিস্তি দিতে গেলে আমার ধারণা খোদ ইবলিশ শয়তানও লজ্জায় মুখ ঢাকবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে গোপনে মিত্র দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছ। নরকে সম্ভবত তুমিই একমাত্র লোক যার শাস্তির মেয়াদ কখনই শেষ হবে না। সে যাই হোক তুমি আমার কাছে কি চাও?
নরকে বসে বসে আমি একটা বই লিখেছি, সহজ শাস্তির ১০০১ টি টিপস -এটাতে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির উপর টিপস দেয়া আছে। আমি আপনাকে বইটি দিয়ে সাহায্য করতে পারি, বিনিময়ে আমাকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।
দেবদূত কিছুণ চিন্তা করে বলেন ঠিক আছে, তুমি আমাকে বইটা দাও আমি দেখি তোমার জন্যে কি করতে পারি।
লোকটা হাত নেড়ে জানতে চায়- তার মানে আপনি আমার চুক্তি গ্রহণ করছেন।
আগে আমি তোমার বইটা পড়ে দেখি, আর স্বর্গে পাঠানো না পাঠানোর ব্যাপারে আমি একক ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে, তার জন্যে কয়েকটা দিন তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

কয়েকদিন পর।
দেবদূত লোকটাকে তার বই ফেরত দেন-তোমার আইডিয়া আমাদের পছন্দ হয়নি। তাই তোমার সাথে আমরা কোন ধরনের চুক্তিতে যাচ্ছি না। আর তোমার সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, অতীতে তোমার সাথে যে দেশেরই চুক্তি হয়েছে পরবর্তীতে তারা ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়েছে। অতএব আমরা একই ভুল করতে যাচ্ছি না।
এর কিছুদিন পর।
নরকে শাস্তির মাত্রা ভয়বহ আকার ধারণ করে। প্রতিদিন নতুন নতুন শাস্তির মাত্র যোগ হয়। এবার লোকটা সরাসরি নরক প্রধানের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে-আপনাদের এখানকার দেবদূত প্রধান আমার বই থেকে আইডিয়া চুরি করেছেন। আমাকে স্বর্গেতো পাঠাননি উপরন্ত আমার আইডিয়াই আবার আমার উপর প্রয়োগ করছেন।
নরক প্রধান ম্লান হেসে উত্তর দেন-এখানে যা কিছুই ঘটে সব আমার র্নিদেশেই হয়ে থাকে। আমি থাকি পর্দার আড়ালে। তুমি দেবদূত প্রধানের কাছে যে বইটা দিয়ে ছিলে আমরা এরই মধ্যে সেই বইটার অনেকগুলি কপি করে ফেলেছি। এর একটা কপি আমার কাছেও আছে।
ওহ্ নো- লোকটা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। আপনারা তাহলে আমার সাথে চিটিং করেছেন।
এটাও আমরা তোমার বই পড়েই শিখেছি, কি ভাবে বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্ব করতে হয়, আবার চুক্তি ভঙ্গ করে কি ভাবে তাদের সর্বনাশ করতে হয়।
লোকটা মাথার চুল ছিড়তে শুরু করে-ইস আমি এত বুদ্ধিমান লোক হয়ে কিভাবে এত বড় বোকামি করলাম। আমি বন্ধু ভেবে তোমাদের বিশ্বাস করে ছিলাম, আর তোমরাই আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলে।
নরকপ্রধান উ”চ্চ স্বরে হাসতে শুরু করেন তুমি সবচেয়ে বড় ভুল কি করেছ জান? তোমার বইয়ের এক কোনে মনের ভুলে লিখে রেখেছ- আর যাকেই বিশ্বাস করো অন্তত আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানকে কখনও বিশ্বাস করো না। আর তোমার জন্যে আমার বিনামূল্যে টিপস হচ্ছে, আর যাকেই বিশ্বাস করো নরকের বাসিন্দাদের কখনই বিশ্বাস করো না। কারণ, বিনা কারণে কাউকে নরকে পাঠানো হয় না। এখানকার পরিবেশের জন্যে উপযুক্ত লোকদেরকেই এখানে পাঠানো হয়ে থাকে।
এই বলে নরকপ্রধান বিদায় নেন।
নরকে প্রতিদিন নিত্য নতুন শাস্তি পুরোদমে চলতে থাকে।

*** যুদ্ধের প্রথম বোমাটা পড়ে হৃদয়ের ঠিক মাঝখানে। গুড়িয়ে যায় সমস্ত মূল্যবোধ- মানবতা- প্রেম -ভালবাসা । (লেখক: এরিক মারিয়া রেমার্ক)

Wednesday, June 4, 2008

অন্ধকারের যাত্রী

তুহিন তুই বোস, তোর ট্রেন তিন ঘন্টা পর আসবে- আমি আসছি।' আসলাম সেই যে উধাও হল এখন র্পযন্ত কোন খবর নেই।
তুহিনের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই ভুতূড়ে স্টশেনে ট্ট্রেনের জন্যে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। কয়েক দিন ধরে এমনিতেই তার দম ফেলার সময় নেই। তারপরও আসলামের বোনের বিয়েতে এক দিনের ছুটি নিয়ে এই মফস্বলে আসতে হয়েছে। আজই ঢাকা ফিরে যেতে হবে।

এমনিতেই স্টেশনে তেমন লোকজন নেই তারপর মাথার উপরে টিমটিম করে যে স্বল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে তাতে করে রাতের এই অন্ধকার তেমন দূর হচ্ছে না।

সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যপার হচ্ছে স্টেশনের বেঞ্চে তার পাশে বাইশ-তেইশ বছরের এক মেয়ে বসে রয়েছে। সম্ভবত এই ট্রেনেরই যাত্রী হবে। প্রথমে তুহনি ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিল।

ভয়ে ভয়ে তুহনি জিঞ্জেস করে, আপনি কি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছেন? ট্ট্রেন তিন ঘন্টা লেট। আপনি একা আপনার সাথে কি আর কেউ নেই।
আপনার কোন অসুবিধা আছে। আর একা কই, আপনে আছেন না।

তুহনি কিছুই বুঝতে পারে না। এই মেয়ের সমস্যা কি।

কি ব্যপার আপনে এই ভাবে তাকাই আছেন কেন? কোন সময় মেয়ে মানুষ দেখেন নাই।
আপনি এ রকম বাজে ভাবে কথা বলছনে কেন?-তুহিন অবাক হয়।
আমি বাজে মেয়ে, এই জন্যে বাজে ভাবে কথা বলছি।

তুহিন হতভম্ব। কোন কথা বলতে পারে না।

আপনে কি করেন? - মেয়েটি একটু পর জানতে চায়।
আমি সফটওয়্যার বিক্রি করি। আর আপনি কি করেন?
আমি আত্না বিক্রি করি।

বুঝলাম না।
বেশী বুইঝা লাভ নাই। আপনের ঐ জিনিস কি ওয়্যার বিক্রি কইরা প্রতিদিন কত পান?
বিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার নীচে কোন সফটওয়্যার আমরা বানাই না।
মেয়েটির চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠে। জানেন আত্না বিক্রি কইরা প্রতিদিন আমি মাত্র ১০০-২০০ টাকা পাই।

আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন?
আপনে ভদ্রলোক তো তাই বুঝতে পারছনে না। আপনার মত ভদ্রলোকরা প্রতিদিন আমার কাছে আসে, তারার নোংরা হাত আমার গায়ে রাখে তারপর ঘন্টা হিসাব কইরা তারা আমার আত্না কিননা নেয়।

হঠাত করে তুহিনের মনে হয় চারদিকে এতো খোলা বাতাস তারপরও সে ঠিক মতো নি:শ্বাস নিতে পারছে না। অনেক্ষণ পর জিঞ্জেস করে-তুমি এরকম এক অন্ধকার জীবন কেন বেছে নিলে?

মেয়েটির মুখে বিষন্ন হাসি দেখা দেয়। কেউ কি আর ইচ্ছা কইরা এই জীবন বাইছা নেয়। সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে এইটা রাখছেন। প্রতদিনি সকালে যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখি তখন খুব লজ্জা হয়। নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে। তারপর আবার সব কিছু ভুইলা যাইতে হয়।
দুনিয়াতে খাওয়ার কষ্ট সবচাইতে বড় কষ্ট। এর জন্যেই আপনে সফটওয়্যার বেচেন, আর আমি বেচি আত্না। দুইটাই ব্যবসা। পার্থক্য শুধু, একটা আলো আর একটা আঁধারের।

সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করছ কেন? তিনি তো কারো অমঙ্গল চান না।

শুনছি পরকালে দোজখে একটা লোকের বার বার মৃত্যু ঘটব, তারপর তারে বার বার জীবিত কইরা শাস্তি দেয়া হইব। আর এইখানে প্রতদিনি আমার আত্নার মৃত্যু ঘটে। এইটা সৃষ্টিকর্তার কেমন বিচার।

তুহিন কোন কথা বলতে পারে না। নিজের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব কর। এটা কি এই মেয়ের জন্য? সে জানে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুহনি বলে- আমি যদি তোমাকে ঢাকা নিয়ে যেতে চাই তবে কি তুমি আমার সাথে যাবে? অন্তত চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি, নতুন ভাবে আবার সব কিছু শুরু করা যায় কিনা।

ঢাকা তো আমি এই ট্রেনেই আপনার সাথে যাচ্ছি, কিন্তু তারপর আমি যাব আমার রাস্তায় আর আপনি আপনার পথে।
দেখ তুমি চাইলে আমি ঢাকাতে তোমার জন্যে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

উপরে তাকায় দেখেন ভোর হইয়া আসছে। ভোরের আলোয় রাতের অন্ধকারের কোন কথা আপনার মনে থাকব না। কারো থাকে না। মেয়েটির মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠ।

ভোররে আলো আঁধারের মাঝে তুহিনের মনে হয়, এ রকম র্স্বগীয় হাসি সে অনেক দিন দেখেনি।


====০====



( বাংলাদেশের একজন বির্তকিত নারীবাদী লখিকা, যার লেখা একসময় এই দেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। তিনি র্বতমানে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বির্তকিত লেখার জন্যে ভিসা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। এই লেখিকার সমগ্র পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি রয়েছে সীমাহীন ঘৃণা।

নারী স্বাধীনতার পেছনের বাধাসমূহ তিনি একটি একটি করে খুঁজে বের করার চষ্টো করেছেন। প্রথম বাধা হচ্ছে আমাদের র্ধমগ্রন্থসমগ্র, উনার মতে এখানে নারীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। তারপর র্ধমপ্রচারকরা, এরা সবসময় নারীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। র্সব শেষ বাধা পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা।

নারী স্বাধীনতা আমার মতে খুব কঠিন একটি জিনিস, অতএব এত বড় একজন লেখিকাকে নিয়ে আমি কোন ধরনের মন্তব্য করতে যাচ্ছি না, সেই ধৃষ্টতাও আমার নেই।

আমার উদ্দশ্যে ভিন্ন।

মুম্বাইয়ের যে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে তিনি এক সময় থাকতেন তার ভাড়া ছিল মাসিক পয়তাল্লিশ হাজার রুপি। আমাদের দেশে মাত্র পয়তাল্লি শত টাকার জন্যে একটি মেয়ের বিয়ে ভেংগে যায়। দারিদ্রতার কারণে মা তার তিন সন্তানকে পুকুরে ডুবিয়ে মেরে নিজে গলায় ফাঁস দেন। সৃষ্টিকর্তা যদি আপনাকে সার্মথ্য দিয়ে থাকেন তাহলে নারী স্বাধীনতা নিয়ে গলা না ফাটিয়ে ঐ সব মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন।)